শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আসাদউদ্দীন ওয়াইসি, আব্বাস সিদ্দিকী বিজেপির ভোট কাটুয়া, নাকি ভারতীয় মুসলিমদের মুক্তির রাহবার?

মেহেদী হাসান পলাশ | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লীর বিজ্ঞানভবনে পশ্চিববঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুনীল আরোরা। মোট ৮ দফায় ২৯৪টি আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার একাংশ, ঝাড়গ্রাম ও পূর্ব মেদিনীপুরের একাংশ ও পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশের ৩০ টি বিধান সভা আসনে নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটিং শুরু হবে ২৭ এপ্রিল এবং ২ মে অষ্টম দফায় মালদা ও মুর্শিদাবাদের বাকি অংশে, বীরভূম ও উত্তর কলকাতার ৩৫টি আসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই ভোটিং কার্যক্রম শেষ হবে। নির্বাচন কমিশনের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৭ কোটি ৩২ লক্ষ ৯৪ হাজার ৯৮০। পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ৭৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ৩০৬ জন। মহিলা ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ৫৯ লক্ষ ২৭ হাজার ৮৪ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ১৫৯০ জন। বাংলাদেশের সাথে বিশাল সীমান্তসংলগ্ন এই ভারতীয় রাজ্যের ১২০ আসনে জয় পরাজয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করেন মুসলিম ভোটাররা। ২০১১ সালের শুমারী অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৭.০১ শতাংশ। তবে সেখানকার মুসলমানদের দাবী, এই সংখ্যা আরো বেশী। আর ২৯৪ টি আসনের মধ্যে ১২০ টি আসনের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন মুসলিমরা। বাংলাদেশ সংলগ্ন জেলা মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বীরভূমে মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ৬৬.২৮%, ৫১. ২৭%, ৪৯.৯২%, ৩৫.৫৭% এবং ৩৭.০৬%। এ আসন সংখ্যা ৪৩টি। এই সংখ্যালঘু ভোটের উপর দাঁড়িয়েই পশ্চিমবঙ্গে টানা ৩৪ বছর শাসন করেছে সিপিএম। এরপর সংখ্যালঘু ভোটাররা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বর্তমানে এই ভোট ব্যাংক তৃণমুল কংগ্রেসের জোড়া ঘাঁসফুলে। তাতেই ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনে জিতে টানা দুই মেয়াদে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ক্ষমতায় রয়েছেন এ রাজ্যে।বর্তমানেও সংখ্যালঘু ভোটারদের সিংহভাগ নিজের দখলেই রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। রাজ্যের ভোটের রাজনীতির এই চিত্র কেন্দ্রের বিজেপি সকারের কাছেও রয়েছে।
সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করেও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে মাইলস্টোন এখনো গাড়তে সক্ষম হয়নি। বিষয়টি চোখের বালির মতোই বিজেপি নেতাদের খুঁচিয়ে যায় সবসময়। কেননা, তারা যে রাজনীতি ধারণ করে ভারতবর্ষ জয় করেছে, সেই রাজনীতির ভিত গড়ে উঠেছে এই পশ্চিমবঙ্গেই। বিজেপির প্যাটার্নাল সংগঠন বিনায়ক দমোদর সাভারকারের প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এই বাঙলার সন্তান। শুধু শ্যামা মুখার্জি নয়, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত অরবিন্দু ঘোষের অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দলের মতো বৈপ্লবিক গুপ্ত সংগঠনগুলো বাংলায় ব্রিটিশরাজের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেই বাংলায় মাইলস্টোন গড়তে বিজেপি এবার মরিয়া। বিশেষ করে গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৪০ টি আসনের মধ্যে ২টি আসন থেকে একলাফে ১৮টি আসন লাভ করে বিজেপি দারুণ চাঙ্গা। তাই যে কোনোভাবেই পশ্চিমবঙ্গ চাই তাদের। তবে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ব্যাপক সাফল্য লাভ করলেও সংখ্যালঘু ভোটের অবদান তাতে খুব বেশী প্রভাব বিস্তার করেনি। লোকসভা ভোটের নিরিখে রাজ্য বিধানসভার ১২১টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেস ২২টি লোকসভা আসনে জয়ী হয়েছিল। আর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিধানসভার ১৬৩টি আসনে এগিয়ে ছিল। অর্থাৎ ২৭টি আসনে পিছিয়ে তারা। এই সমীকরণে ২% ভোট কাটতে পারলেই বিজেপির পোয়াবারো।কিন্তু সংখ্যালঘু ভোটের সমীকরণ বিজেপির জানা। তাই বিজেপি চাইছে নিজেরা না পারুক অন্য কেউ অন্তত তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসাক।
এ প্রেক্ষাপটেই আলোচনায় এসেছে আসাদ উদ্দীন ওয়াইসি ও তার দল অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (AMIM) বা (MIM) নাম । বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া বিহারে মিমের সাফল্য বিজেপিকে আশাবাদী করে তুলেছে। বিহারের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-জেডিউ নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট জয়ী হয়েছে। অন্যদিকে, প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস-আরজেডি নেতৃত্বাধীন মহাজোট পরাজিত হয়েছে। মোট ২৪৩ আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছে ১২৫ আসন। মহাজোট পেয়েছে ১১০ আসন। বিহারে ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫টি আসন দখল করেছে ‘মিম’। রাজ্যটিতে আরজেডি ও কংগ্রেসের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ওয়াইসির ‘মিম’ দল ভাগ বসানোয় ভোট বিভাজনের ফলে রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত সীমাঞ্চলে বিজেপি ও এনডিএ জোট ভাল ফল করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, অন্তত ১০-১২ টি আসনে মিমের ভোট কাটাকুটিতে সুবিধা পেয়েছে এনডিএ জোট। মিম যে আসনগুলোতে জয়লাভ করেছে সেগুলো আবার পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া। বিহারে জয়লাভের পরই মিম নেতা পশ্চিমবঙ্গে আসছেন বলে ঘোষণা দেন। এরপরই সংগঠনটি রাজ্য জুড়ে ব্যাপক আলোচনায় আসে।
ভারতীয় রাজনীতিতে অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (AMIM) নামটি নতুন করে আলোচনায় এলেও সংগঠনটি কিন্তু নতুন নয়। সংগঠনটির জন্ম ১৯২৭ সালে হায়দ্রাবাদে। হায়দ্রাবাদ ও বেরার রাজ্যের শেষ নিজাম ছিলেন মীর ওসমান আলী খান বাহাদুর। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে হায়দ্রাবাদ রাজ্য ছিল দেশীয় রাজ্যসমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ। উসমান আলি খান তার পিতার মৃত্যুর পর ১৯১১ সালে নিজাম হন। তিনি ১৯১১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ শাসন করেছেন। এরপর অপারেশন পোলোর ফলে হায়দ্রাবাদ ভারতের অংশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তাকে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের রাজপাল করা হয়। ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এসময় রাজ্যকে ভাষার ভিত্তিতে ভাগ করে অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের অংশ করা হয়। ওসমান আলী খানের পরামর্শে নবাব মেহমুদ নওয়াজ খান ১৯২৭ সালে দলটি গঠন করেন। ১৯৩৮ সালে বাহাদুর ইয়ার জং মিমের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাহাদুর জংয়ের মৃত্যুর পরে সভাপতি হন কাসমি রিজভি। তার অনুসারীগণ হায়দরাবাদের ভারতভুক্তির বিরোধিতা করে। মিম হায়দরাবাদকে স্বাধীন ‘দক্ষিণ পাকিস্তান’ হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারত হায়দ্রাবাদ দখল করে নিলে ১৯৪৮ সালে মিম নিষিদ্ধ হয় ও রিজভীকে আটক করা হয়। কারাবাসের পরে দেশত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার শর্তে মুক্তি পেলে দেশত্যাগের আগে রিজভি মিমের দায়িত্ব তাঁর উকিল আবদুল ওয়াহিদ ওয়াইসির হাতে তুলে দেন। আবদুল ওয়াহিদ ওয়াইসি ‘অল ইন্ডিয়া মজলিশ-এ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ নামে দলের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তার পর থেকে মিমের নেতৃত্ব ওয়াইসি পরিবারের হাতে। আবদুল ওয়াহিদের মৃত্যুর পরে (১৯৭৫) তাঁর পুত্র সুলতান সালাউদ্দিন ওয়াইসি দলের দায়িত্ব নেন। ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত লাগাতার সাত বার তিনি হায়দরাবাদ কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন। তার পর তার বড় ছেলে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি দলের সভাপতি হন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি হায়দ্রাবাদ লোকসভা কেন্দ্র থেকে জিতে সংসদে যাচ্ছেন। বিজেপি সরকার তাকে ২০১৪ সালে সংসদরত্ন সম্মানে ভূষিত করে।
২০১৪ তেলেঙ্গানা বিধানসভা নির্বাচনে মিম সাত আসন জয়লাভ করে সাড়া ফেলে দেয়। লোকসভা ভোটেও মহারাষ্ট্রে একটা আসন জেতে মিম। সেখানে এ বারের বিধানসভাতেও একজন বিধায়ক রয়েছেন মিমের। কিন্তু মিম যত আসনে জিতেছে তার চেয়ে অনেক বেশি আসনে মুসলিম ভোট কেটে কংগ্রেসের যাত্রা ভঙ্গ করেছে। তাতে লাভ হয়েছে বিজেপির। ঝাড়খন্ডে বিধানসভা ভোটে একটি আসনেও জিততে পারেনি মিম, কিন্তু মুসলিম ভোট কাটাকুটির খেলায় বিজেপিকে ৮টি আসনে জিতিয়েছে। একই কাজ তারা বিহারেও করেছে। এরপর থেকেই বিজেপির প্রতিপক্ষের দলগুলো থেকে মিমের গাঁয়ে ‘বিজেপির ভোট কাটুয়া’ তকমা সেঁটে দেয়া হয়েছে। বিহার নির্বাচনের সময় মহাজোটের নেতারা মিমের সঙ্গে বিজেপির একটি গোপন বোঝাপড়া রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। বিজেপি বা মিম— দু’পক্ষই এই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়।
বিহারে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করার পর এআইএমআইএমের তরফে ঘোষণা করা হয় যে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও মধ্যপ্রদেশের মতো অন্যান্য মূল রাজ্যে দলীয় সংগঠনকে শক্তিশালী করে তারা নির্বাচনে লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সূত্রের খবর, উত্তরপ্রদেশে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে আঞ্চলিক দল সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়তে চলেছে মিম।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিহার বিধানসভা নির্বাচনে মিম যে কটি আসনে জিতেছে তার প্রায় সবকটিই পশ্চিমবঙ্গ সীমানা লাগোয়া। উত্তর দিনাজপুর ও মালদা জেলা লাগোয়া এই আসনগুলির অধিকাংশই মহাজোটের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। তার পর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় মিমের মিছিল দেখতে পাওয়া যায়। মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় দেখা যায় মিছিলগুলি। ভোটের অংক বলছে, মিম পশ্চিমবঙ্গে প্রার্থী দিলে সব থেকে বেশি ক্ষতি হতে পারে তৃণমূলের। কারণ, রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে এখন একচেটিয়া আধিপত্য তৃণমূলের। সেক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলায় তৃণমূলের যেমন আধিপত্য করে রাখা মুশকিল হবে তেমনই উত্তর দিনাজপুর ও মালদার মতো জেলা উদ্ধার করা মুশকিল হয়ে যাবে। ফলে তৃণমূলের মধ্যে এ নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল জল্পনা-কল্পনা। তাই এ নিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজেই মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। মিম সম্পর্কে তার বক্তব্য, ‘ওরা কিন্তু বিজেপির বি-টিম। ওরা বিজেপির টাকা নেয়। সংখ্যালঘুরা ভুল করবেন না। ওদের বাড়ি হায়দরাবাদে। এখানে নয়।’ তবে একেরপর এক এই অভিযোগে বিরক্ত মিম প্রধান আসাদউদ্দীন ওয়াইসি নিজেও। তাই জবাব দিয়ে বলেছেন, তাঁর দলের সঙ্গে অস্পৃশ্যের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি আমাদের ভোট কাটুয়া বলে ডাকে। কিন্তু ভোটাররা কি কারও বাঁধা দাস? সবসময় কি একটি দলকেই ভোট দিতে হবে?”
এদিকে বিজেপির সঙ্গে মিমের সম্পর্কের কথা বা মিমের কার্যক্রমে বিজেপির সহায়তার কথা মিম অস্বীকার করলেও দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এ নিয়ে নীরব ভূমিকা অবলম্বন করেছেন। তবে এ নিয়ে গোমর ফাঁস করেছেন উত্তর প্রদেশ বিজেপির এক সংসদ সদস্য সাক্ষী মহারাজ। উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ের সাংসদ সাক্ষী মহারাজের দাবি, ‘সম্প্রতি বিহার নির্বাচনে বিজেপি–কে সহায়তা করেছে অল ইন্ডিয়া মজলিস–এ–ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েসি। তিনি একইভাবে উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনেও আমাদের দলকে সাহায্য করবেন।’
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ঘোষণা দেয়ার পর থেকে আসাদউদ্দীন ওয়াইসি এ রাজ্যে দল গঠন ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। শুরুতে বেশ সাড়াও পেয়েছিলেন। বিশেষ করে বিজেপি সমর্থিত মিডিয়াগুলো মিমের কার্যক্রমের বড় প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলোতে সংগঠনটি রীতিমত অফিস খুলে দলের কার্যক্রম শুরু করে। এরমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসেন আসাদউদ্দীন ওয়াইসি। তিনি রাজ্য সফরে এসে চলে যান ফুরফুরা দরবার শরীফে। সেখানে আব্বাস সিদ্দিকীর সাথে বৈঠক করে একত্রে জোট গঠন করে নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
ভারত ও বাংলাদেশের অত্যন্ত সম্মানিত ফুরফুরা দরবার শরীফের চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি আব্বাস সিদ্দিকীর গায়েও ইতোমধ্যেই ‘বিজেপির ভোট কাটুয়া’ তকমা লাগিয়েছে তৃণমূল সমর্থকেরা। এনআরসি নিয়ে জোরালো বক্তব্য রেখে আলোচনায় আসা আব্বাস সিদ্দিকী চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট(আইএসএফ) নামে দল গঠন করেছেন। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, দিদিকে রক্ষার দায়িত্ব তার নয়। তাদের দুজনরই বক্তব্য ভারতীয় মুসলমানরা আর কতোদিন এ দল ও দলের ভোট ব্যাংক হয়ে থাকবে। ভারতীয় মুসলমানদের দাবী ও অধিকার আদায়ে নিজস্ব দল প্রয়োজন।
তবে তার এই দল গঠন ও রাজনীতিতে আসাকে ভালভাবে নেননি ফুরফুরা দরবার শরীফের আরেক সদস্য ও তার চাচা পীর সাহেব ত্বহা সিদ্দিকী। তিনি আব্বাস সিদ্দিকীর তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, ‘রাজ্যে মুসলিম ভোটে বিভাজন করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজেপি ও আর এস এস আব্বাস সিদ্দিকীকে মাঠে নামিয়েছে।’ ত্বহা সিদ্দিকী বলেন, ‘ফুরফুরার পীরসাহেব এবং পীরজাদাদের বংশের কেউ এমন কাজ করতে পারে তা কেউ ভাবেনি। আব্বাস ময়দানে খেলতে নেমেছে স্রেফ মুসলিম ভোট ভাগ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য ওর সফল হবে না। পশ্চিম বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মসনদে বসাবে না।’ ত্বহা সিদ্দিকী আরো বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও লড়বে কি। ওর বিরুদ্ধেই তো নলেজ সিটির কোটি কোটি টাকা হেরাফেরির দুর্নীতির অভিযোগ আছে। আব্বাস সিদ্দিকীর মুখে দুর্নীতির কথা মানায় না। তিনি বলেন, ফুরফুরার পীরজাদা, পীরসাহেবদের একটা ঐতিহ্য আছে। সক্রিয় রাজনীতিতে তারা নামেন না, আব্বাস সেই রীতি ভেঙেছে। মুসলিমরা ওর পাশে থাকবে না।’ শুধু আব্বাস সিদ্দিকী নয়, ওয়াইসির সমালোচনা করে ত্বহা সিদ্দিকী আরো বলেন, ‘আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বাইরে সাদা কাপড় পরে রয়েছেন, কিন্তু ভিতরে রয়েছে তার গেরুয়া রং।’
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, নির্বাচনের ঘোষণা নিয়ে মাঠ গরম করলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিত আসাদ উদ্দীন ওয়াইসি ও তার দল মিম। বরং একের পর এক ধাক্কা খেয়ে চলেছেন তিনি। প্রথমেই তার সবচেয়ে বড় ভরসা আব্বাস সিদ্দিকী তাকে ফেলে ব্রিগ্রেডে বাম-কংগ্রেসের হাত ধরে জোট গঠন করেছেন। এরপর পশ্চিমবঙ্গে মিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈয়দ জামিরুল হাসান পদত্যাগ করেছেন। জামিরুলের দাবী, “নির্বাচনে লড়াইয়ের সমস্ত প্রস্তুতি নিলেও হঠাৎ করেই ওয়াইসি চুপ করে গিয়েছেন। কারণটা সকলের অজানা। এ রাজ্যের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণার পর কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহের বেশি, তবুও মিমের দলীয় নেতৃত্ব এখনও দিশাহীন। রাজ্যের নেতারা মানসিক প্রস্তুতি নিলেও শীর্ষ নেতৃত্ব কোনও উদ্যোগ নিচ্ছেন না বলেই অভিযোগ করেন তিনি। এরপরই জামিরুল বলেন, ‘আমরা এই বিধানসভা নির্বাচনে আমরা তৃণমূলকেই সমর্থন করব।’
প্রকৃতপক্ষে তিন তালাক, জম্মু কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল, বাবরী মসজিদ, নাগরিকত্ব আইনসহ বেশী কিছু ইস্যুতে ভারতীয় মুসলমানদের মনে বিজেপি রক্তাক্ত আঁচড় কেটেছে। এনআরসি নিয়ে, বাঙালী মুসলিম খেদাও ইস্যু নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা ইতোমধ্যেই যেসব আক্রমণাত্মক বক্তব্য রেখেছেন তা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। আসলে সমগ্র ভারতে বিজেপি ভোটের সমীকরণ পাল্টে দিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উষ্কে দিয়ে ভোটারদের বিভক্ত করতে পেরেছে সফলভাবে। ধর্মীয় জাতীয়তাবোধে বিভক্ত ভোটের একটি অংশের পুরো সুবিধা নিয়েছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গেও কাজটি সফলভাবেই করতে পেরেছে এবং তার ফল পেয়েছে লোকসভা নির্বাচনে। তবে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলকে খুব বেশী আমলে নিতে চাইছে না তৃণমূল, বাম ও কংগ্রেস। কেননা, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের সমীকরণ এক নয়। এখানে আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু ও প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
তবে দুই ‘ভোট কাটুয়ার’ বিচ্ছেদ ও জমিরুলের পদত্যাগ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে অনেকের অভিমত, মিম শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবাংলায় মনোনয়ন দেয়ার মতো প্রার্থী খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ। বিষয়টি সত্য কিনা যাচাই করা না গেলেও একথা সত্য যে, তিনি এ রাজ্যে জোটসঙ্গী হিসেবে কাউকেই পাচ্ছেন না। অবশ্য তাতে তার সমস্যা হবার কথা নয়। কয়েকটি রাজ্যে তিনি একলাই নির্বাচন করে বেশকিছু আসনে ভোটের ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। পশ্চিমবঙ্গে তা পারবেন কীনা তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে ২ মে ২০২১ পর্যন্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (12)
Nizam Uddin Sikdar ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৩ এএম says : 0
রাহবার। ভোট কাটুয়া এ শ্লোগান দিয়ে ৭০ বছর ধরে নির্যাতিত।
Total Reply(0)
Jashim Uddin Rahul ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৪ এএম says : 0
দুনিয়ার মুসলিম এক হও
Total Reply(0)
Maruf Kamal Khan ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৬ এএম says : 0
ইতিহাস সাক্ষী মুসলিমদের ক্ষতি বুঝে কিংবা না-বুঝে মুসলিম বা মুসলিম নামধারীরা অমুসলিমদের চেয়ে কম করেনি। যে-সব অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, দুর্বল ও শাসনক্ষমতা থেকে বঞ্চিত সেসব জায়গায় মুসলিম নেতৃত্বকে কৌশল, মিত্র নির্বাচন, অ্যাপ্রোচ ও বক্তব্যের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুনির্বাচিত হতে হয়, হেকমতের পরিচয় দিতে হয়। কিন্তু তার বদলে আমরা অনেক বেশি হঠকারিতা কিংবা গোপন সমঝোতা অথবা নিজ স্বার্থে কম্যুনিটির স্বার্থ বিসর্জন দিতে দেখি। ইন্ডিয়ায় মুসলিম নেতৃত্বের সাম্প্রতিক বিন্যাস, জোটবদ্ধতা ও মিত্রবাছাইয়ের ক্ষেত্রে আসলেই দুর্ভাবনায় ফেলে দেয়ার মতন উপাদান যুক্ত হয়েছে। ইন্ডিয়ায় বাংলাদেশের স্বার্থ এবং সে-দেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের স্বার্থ এক নয়। তাছাড়া প্রতিটি রাজ্যের বাস্তবতাভেদে কৌশলও ভিন্ন হওয়া উচিত।
Total Reply(0)
Alm Fazlur Rahman ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৭ এএম says : 0
এরা কোনোদিন নিজের ছাড়া মুসলমানদের কথা ভাবেনি। বাংলাদেশের পীরেরা মুরিদের নেয় দেয়না। এটাই চলে আসছে। তার পরেও এরা আছে, থাকবে।
Total Reply(0)
Shahadat Hossain ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৭ এএম says : 0
প্রশ্ন হলো, মুসলিমরা শুধু বাম বা কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক হয়েই কেবল থাকবে কেন? তারা কি তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্ত্বা নির্মাণে মনোযোগী হবেনা? আরেকটি কথা। এতদিন তো তারা কংগ্রেস আর বামেদের সাথেই ছিলো। তারপরও বিজিপির উত্থান ঠেকানো যায়নি কেন?
Total Reply(0)
Israfeel Shohel ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৮ এএম says : 0
সহমত তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে মুসলিম শতাংশ তুলনামূলক ভাবে কাশ্মীর আসামের পর সবচেয়ে বেশী, সেখানে মুসলমানদের নিজেস্ব কোনো দল না থাকায়, সেক্যুলার (চুপা আরএসএস আদর্শ লালনকারি) দলগুলো মুসলিমের সাথে প্রতারণা করে আসছে, চাকরি বাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে, কিন্তু উপরে উপরে এমন ভাব ধরে আছে যেনো তারা মুসলমানদের তোষণ করতেছে অথচ ভাগে যা পাওনা যেটার এক তৃতীয়াংশও (৩০%/১০%) দিচ্ছে না। তাইতো বাহির থেকে (হায়দ্রাবাদ) মিমের মতো মুসলিম ঘেষা দলগুলো কে আসতে হচ্ছে। তবে এই নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারবে না কারণ বিজেপি রুখতে মুসলমানরা একচেটিয়া তৃণমূল কে ভোট দিবে (আব্বাস কেও প্রত্যাখ্যান করবে)
Total Reply(0)
Md Sohel ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৯ এএম says : 0
মূসলমানদের উচিত মমতা কে ভোট দেওয়া।নাহলে বিজেপি জিতে গেলে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে।মূসলিম সংগঠনগুলোকে কৌশলী হওয়া উচিত।বিজেপিকে রুখতে হবে
Total Reply(0)
Shahin Khan ২৫ মার্চ, ২০২১, ১২:৫৯ এএম says : 0
আব্বাস সিদ্দিকী বিজেপির হয়ে কাজ করছে,এটা এখন পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে,,, সুতরাং ভোটের দিন যত সামনে আসবে মুসলিম ভোট তত তৃনমুলে ব্যাক করবে
Total Reply(0)
কাজী হাফিজ ২৫ মার্চ, ২০২১, ১:০২ এএম says : 0
তাদের এই দূরদরশীহীন করমকান্ডে ভারতের মুসলিমরা ক্ষতিগস্ত হচ্ছে।
Total Reply(0)
মোঃ রহমান ২৫ মার্চ, ২০২১, ৩:৫৪ এএম says : 0
আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বা মিম বা AIMIM দের চুপ হয়ে যাওয়াই ভাল হয়েছে। বরং ভোটের আগ দিয়ে হঠাৎ ঘোষণা দয়ে ISF জোট বা সংযুক্ত মোর্চার সাথে মিশে যাওয়া, মিশিয়ে দেয়া উচিৎ। বৃহত্তর আন্দোলনে সবাইকে নিয়ে জোট করতে হয়। এখানে আব্বাস সিদ্দিকি যেভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ দের সাথে মিলে গেছে, ধর্মনিরপেক্ষরাও যেভাবে তাকে নেতা মেনেছে। সেটা মুসলিম দল মিম আর ধর্মনিরপেক্ষ বাম দলদের সাথে হচ্ছে না। তাতে আবার বিরোধিপক্ষ পানি ঘোলা করার চেষ্টা করত। আমার জ্ঞানে যতটুকু বুঝ আসে মিমের স্বেচ্ছায় সংযুক্ত মোর্চার সাথে মিশে যেতে অসুবিধা নাই। তবে বাম ধর্মনিরপেক্ষদের মিমের সাথে মিশে যেতে অসুবিধা আছে। তাই ভবিষ্যতের বৃহত্তর স্বার্থে বর্তমানে মিমের ISF এর সাথে / পক্ষেই ভোট করা উচিৎ।
Total Reply(0)
চৌধুরী হারুন আর রশিদ ২৫ মার্চ, ২০২১, ৯:৩০ এএম says : 0
সময় উপযোগী তথ্যভিত্তিক যৌক্তিক একটি লেখা। মেহেদী হাসান পলাশ সাহেবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
Jack Ali ২৬ মার্চ, ২০২১, ৪:৫৯ পিএম says : 0
May Allah bring back india to us and will rule by Qur'an then all the problem will go away and people will be able to life in peace with human dignity.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন