ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি এবার বাংলাদেশে এসে এমন একটি উক্তি করেছেন, যা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি এতই স্তম্ভিত ও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার মুখ দিয়ে বাক্য স্ফুরিত হচ্ছিল না। আমি তাৎক্ষণিকভাবে গত মঙ্গলবারের কলামেই ঐ বিষয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদল করি এই কথা ভেবে যে, চট্ জলদি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে বরং দেখা যাক, খোদ ভারতেই কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হয়েছে। খোদ ভারতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এবং সেই প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন কোনো অয়রহ-গয়রহ ব্যক্তি নন, স্বয়ং ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীবিদ ড. মনমোহন সিং। এর মধ্যে ইংরেজি ‘ডেইলি স্টার’ এবং ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ এই বিষয়ে দুইটি লেখা ছাপা হয়েছে যথাক্রমে ১ ও ২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। প্রিয় পাঠক, আমি আগেই বলে রাখছি যে, বাংলাদেশে এখন রাজনীতিতে চলছে অস্থির সময়। তাই বোধগম্য কারণে এ ব্যাপারে নিজের কথা যতদূর সম্ভব কম বলবো। ডেইলি স্টার এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত নিবন্ধেরই উদ্ধৃতি দেব। ডেইলি স্টারে নিবন্ধটি লিখেছেন সলিল ত্রিপাঠি। নিউইয়র্কে তিনি গবেষণা করেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছেন সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত। তিনি মুক্তিযুদ্ধ কালে কলকাতার ‘দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায়’ রিপোর্ট করতেন। এখন সম্ভবত ফ্রিল্যান্সার। সুখরঞ্জনের উপসম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম, ‘মোদি অসত্য কথা বলেছেন’। সলিল ত্রিপাঠির নিবন্ধের শিরোনাম, Modi’s Arrest in 1971: An Indian Perspective.
সকলেই জানেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের সফরে ঢাকা আগমন করেন। ঢাকা অবস্থানকালে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের’ (তিনি কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলেননি) সময় তিনি বাংলাদেশের সপক্ষে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। এই সত্যাগ্রহ করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন।
প্রিয় পাঠক, ডেইলি স্টার ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের লেখা নিয়ে আলোচনার আগে কয়েকটি অত্যন্ত সাধারণ প্রশ্ন আসে। সত্যাগ্রহ হয় সাধারণত সরকার বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে, যেটাকে ইংরেজিতে এন্টি ইনকাম্বেন্সি বলে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টা থেকে পাকিস্তান আর্মি ক্র্যাকডাউন শুরু করে। ২৬ মার্চ সকাল থেকেই ‘আকাশবানী কলকাতা’ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে ভারত সরকারের অবস্থান ঘোষণা করা হয়। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিমবঙ্গেও ছিল কংগ্রেস মন্ত্রিসভা। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অজয় কুমার মূখার্জী (১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল থেকে ২৮ জুন। তারপর প্রেসিডেন্টের শাসন চলে ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত। ২০ মার্চ ১৯৭২ সালে মুখ্যমন্ত্রী হন সিদ্ধার্থ শংকর রায়)। প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভি ভি গিরি। এদের কথা আমি উল্লেখ করলাম এটা দেখাতে যে, বলতে গেলে সমগ্র ভারত তখন কংগ্রেস শাসিত ছিল। একই সাথে সমগ্র ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল থেকেই বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন ভারতীয় প্রদেশ বা রাজ্যের সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। এসব সীমান্ত দিয়েই লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। বাংলাদেশ ভারত অভিন্ন সীমান্তে যেসব ভারতীয় রাজ্য বা প্রদেশ রয়েছে সেগুলো হলো, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে আসাম, মেঘালয় ও মিজোরাম এবং উত্তর-পূর্বে ত্রিপুরা। বাংলাদেশি শরণার্থীরা অধিক সংখ্যায় আশ্রয় নেন পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায়। তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক আশ্রয় নেন মেঘালয় এবং মিজোরামে।
দুই
রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্র্যাকডাউনের দ্বিতীয় দিন থেকেই ভারত সরকার পাকিস্তান আর্মির ক্র্যাকডাউনের বিরোধিতা করে। তখন নরেন্দ্র মোদির বয়স ছিল ২০ বছর। তখন বিজেপি বলেও কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। ছিল ভারতীয় জনসংঘ। মোদির বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সংস্পর্শে আসেন। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে মোদির বয়স যখন ২১ বছর তখন তিনি আরএসএসের সার্বক্ষণিক কর্মী হন। ১৯৭১ সালে আরএসএস বাংলাদেশ নিয়ে কোনো আন্দোলন করেনি। কারণ, খোদ ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের সরকার এবং জনগণই তো বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। তাই সেখানে কংগ্রেস বিরোধী কোনো দলের সরকার বিরোধী কোনো আন্দোলন করা বা জেলে যাওয়ার কোনো অবকাশই ছিল না।
তবে হ্যাঁ, নরেন্দ্র মোদি একবার আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়েছিলেন। তবে সেটা ১৯৭১ সালে নয়, ১৯৭৫ সালে, যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। আরএসএস ১৯৮৫ সালে মোদিকে বিজেপিতে কাজ করতে পাঠায়। ২০০১ সালে তিনি বিজেপির জেনারেল সেক্রেটারি হন এবং একই বছর কেস্যুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০১৪ পর্যন্ত তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন এবং অদ্যাবধি ঐ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। তাঁর এই সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থেকে দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আন্দোলনে জনসংঘ বা সংঘ পরিবারের কোনো সত্যাগ্রহের প্রয়োজন ছিল না। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গসন্তান শ্যামাপ্রসাদ মূখার্জী ভারতীয় জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনসংঘ নতুন নাম ধারণ করে। নতুন নাম হয় ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। ১৯৮৪ সালে বিজেপি প্রথম লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আসন পায় মাত্র ২টি। ভারতীয় জনসংঘ প্রতিষ্ঠার আগে শ্যামাপ্রসাদ মূখার্জী ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
তিন
এবার আসছি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনের’ কলামে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দলনে নরেন্দ্র মোদি সত্যাগ্রহ করেছেন এবং জেলে গিয়েছিলেন- এমন বক্তব্যকে লিখিতভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সুখরঞ্জন দাস জানিয়েছেন যে, মোদির এই উক্তিতে বাংলাদেশে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটা তিনি বলতে পারছেন না, কিন্তু ভারতে মোদি বিরোধী প্রতিক্রিয়া এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অবিজেপি শাসিত সব রাজ্যের নেতারা ধিক্কার দিয়েছেন। মনমোহন সিং লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন যে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তার সহযোদ্ধা ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে বিজেপির আরেক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর কোনো ভ‚মিকা ছিল না। তিনি কোনো সংগঠনও তৈরি করেননি। মনমোহন সিং বলেন, ‘একজন প্রধানমন্ত্রীর বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন অসত্য বিবৃতি দেওয়া দেশের পক্ষে অপমানজনক’। সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত বলেন, ঢাকায় মোদি তার বক্তব্যে যে এমন অসত্য তথ্য দেবেন সেটা তাঁর সফরের ৪ দিন আগেই জানা গিয়েছিল। কারণ, ঢাকা সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিজেপি অফিস প্রচার করে যে মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। মনমোহন সিং তাঁর বিবৃতিতে আরো বলেছেন যে, এই অসত্য বিবৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের কাছে তার ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।
সুখরঞ্জনের ভাষায়, মনমোহন সিং ঢাকায় মোদির সফরের বিবৃতি নিয়ে এতই ক্ষুব্ধ যে, মোদির উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘দোহাই আপনার, দেশের বর্তমান প্রজন্ম তো বটেই, নবীন প্রজন্মের কাছেও ইতিহাস বিকৃত করবেন না। আপনি বাংলাদেশে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ভোট জেতার জন্য মন্দিরে মন্দিরে পূজা দিয়েছেন। পূজা দেওয়ার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু সেই পূজো পূঁজি করে ভোট ব্যাংক তৈরি বা ক্ষমতা দখলের কোনো অধিকার আপনার নাই।’
এরপর সুখরঞ্জন দাস সোনিয়া গান্ধী, রাজীব গান্ধী প্রমুখ নেতার রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সাথে বিজেপির অসৌজন্যের কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাই আমি সেসব এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। কিন্তু আনন্দবাজারের এই প্রবীণ সাংবাদিক উপসংহারে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পেশাগত কারণে ৯ মাসের প্রতিদিনের বড় বড় ঘটনার সাক্ষী ছিলাম এবং আনন্দবাজারে তার রিপোর্টও করেছি। কিন্তু কোনোদিন দেখিনি, জনসংঘের কোনো নেতা বা কর্মী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছেন। মোদির এ অপপ্রচার এবং ক্ষমতার দম্ভে ভারত বর্ষের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ সবাই উদ্বিগ্ন।’
চার
এবার ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সলিল ত্রিপাঠির নিবন্ধ প্রসঙ্গ। শুরুতেই তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো একটি অনুষ্ঠানকে মোদি তাঁর আত্মপ্রচারণার কাজে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে কী হচ্ছে জানি না, কিন্তু ১৯৭১ সালে নরেন্দ্র মোদির ভ‚মিকা কী ছিল, সেটি নিয়ে ভারতে প্রচুর আলোচনা, বিতর্ক এবং সমালোচনা হচ্ছে।
এরপর সলিল ত্রিপাঠি লিখেছেন, ভারতীয় মিডিয়াতে আপনি যদি মোদির সফরকে দেখেন তাহলে দেখবেন, মতুয়া সম্প্রদায়ের সাথে মোদির বৈঠক এবং মন্দিরসমূহে মোদির পূজা অর্চনার ছবি। এ সবই করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের নির্বাচনে ভোট সংগ্রহের লক্ষ্যে। নিউইয়র্ক থেকে ত্রিপাঠি আরো লিখেছেন, আপনি ভারতে খুব কম গণমাধ্যম দেখবেন, যেখানে মোদির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে বিক্ষোভ এবং পুলিশের গুলিতে মোদি বিরোধী বিক্ষোভে মৃত্যুর খবর রয়েছে। সরকারপন্থী গণমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হয়েছে হেফাজতের বিক্ষোভ এবং হিন্দু মন্দিরে হামলার খবর। এর দ্বিবিধ উদ্দেশ্যের একটি ছিল, ভারতীয়দের মনে বাংলাদেশি হিন্দুদের প্রতি সহানুভ‚তি জাগ্রত করা এবং নাগরিকত্ব আইনে ভারতে আসা হিন্দুদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়া। অথচ, কঠোর বাস্তব হলো এই যে, মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় কোনো মন্দিরে কোনো হামলা সংঘঠিত হয়নি এবং কোনো হিন্দুর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেনি।
ত্রিপাঠি আরও লিখেছেন যে, ১৯৭৫-৭৭ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। তখন জনসংঘের কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করেছিলেন। সেই আটককৃতদের তালিকায় মোদির নাম ছিল কিনা তার খোঁজ খবর কে রাখে? তখন তো মোদি আরএসএসের সার্বক্ষণিক কর্মী। তিনি তো জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন ১৯৮৫ সালে। আর বিজেপি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালে।
প্রিয় পাঠক, আমি নিজস্ব কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলাম। আমরা শুধুমাত্র কিছু তথ্য তুলে ধরলাম। এসব তথ্য জানার পর আপনাদের বলব, ‘বুঝহ সুজন, যে জান সন্ধান!’
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন