চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কেনাকাটায় ব্যাপক দুনীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এতদিন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হলেও এখন ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোর চিত্রও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে জরুরী চিকিৎসা সেবা জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। সরকারী খাতের চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন এবং সহজলভ্য করতে বর্তমান সরকার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করলেও স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম-দুর্নীতির পুরনো চিত্র মোটেও বদলায়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেড়েছে বলে টিআইবি’র এক রিপোর্টে জানা যায়। দেশের বৃহত্তম ও পুরনো ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ রাজধানীর সব সরকারী হাসপাতালেই অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার একই রকম চিত্র বিদ্যমান। স্বাস্থ্যখাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেয়া হলেও এসব বরাদ্দের কতটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে, এর থেকে জনগণ কতটা সুবিধা পাচ্ছে, এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে তেমন তত্ত্ব-তালাশ নেয়া হয়না বললেই চলে। মাঝে মাঝে পত্রিকা বা গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী রিপোর্টে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভেতরকার অনিয়ম-দুর্নীতির কদাকার চিত্র বেরিয়ে আসলে নামমাত্র তদন্ত কমিটি হয়। বেশিরভাগ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বা সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়না। অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িতদের জবাবদিহিতা বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অবস্থার কাক্সিক্ষত পরিবর্তনও হয়না।
গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় অবস্থিত ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বিভিন্ন আইটেমের চিকিৎসা সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি ও ওষুধপত্র কেনার ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। দশ-বারো হাজার টাকা দামের অটোস্কোপ মেশিন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকায়, ১৫ হাজার টাকার ব্লাড ওয়ার্মার মেশিন ৯ লাখ ৩২ হাজার টাকায়, ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা দামের এমআরআই মেশিন ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কিনেছে সংশ্লিষ্ট ক্রয়কমিটি। সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত বিধি-বিধান অমান্য করে দ্বিগুণ থেকে ৫০ গুণ বেশী দামে কেনা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হয়েছে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান এসব অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য দায়ী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি শুধু একটি হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র হলেও দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম ও ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে একই ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যাবে বলে অনেকে মনে করেন। বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ থেকে শতগুণ পর্যন্ত বেশীদামে ক্রয় করা যন্ত্রপাতিও অনেক হাসপাতালে রোগীদের সেবায় তেমন কাজে আসেনা। কোটি কোটি টাকা দামে যন্ত্রপাতি ক্রয় করার পর প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবে তা হাসপাতালে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। অথবা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা যন্ত্রপাতি মেরামত বা কোম্পানীর ওয়ারেন্টি রিপ্লেসমেন্টের কোন উদ্যোগ না নিয়ে রোগীদেরকে বিভিন্ন প্রাইভেট প্যাথলজি সেন্টারে পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকার কমিশন বাণিজ্য করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ দেশীয় সরকারী হাসপাতালগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও কেনা হচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ৩ কোটি টাকার যন্ত্র ১০ কোটি টাকায় কেনার পরও তা’ যদি বছরের পর বছর অকেজা পড়ে থাকে, জনগণের কোন কাজে না লাগে তবে এই দুর্নীতির মহোৎসবের দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিতে হবে। ‘হাসপাতালের যন্ত্রপাতি যেন শোপিস’ এমন শিরোনামে গত বছর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায়। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে সারাদেশে জেলা ও বিভাগীয় শহরের অসংখ্য হাসপাতালে কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতির বেশীরভাগ বছরের পর বছর ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে অথবা কেনার পর কয়েক বছরেও খোলা হয়নি এমন উদাহরণ দেয়া হয় রিপোর্টে। যেখানে দেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, সরকারী হাসপাতালগুলোতে কাক্সিক্ষত সেবা না পেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন, সেখানে সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ ডাক্তারের সহায়তায় সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত মানহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক গজিয়ে উঠছে। খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি’র বিরুদ্ধেও নিয়োগ দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যে যেভাবে পারছে স্বাস্থ্যখাতের সরকারী বরাদ্দ লুটেপুটে খাওয়ার ধান্ধায় আছে। আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন ও সহজলভ্য করণে এ খাতে সরকার কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ও ডাক্তারদের দলবাজি, কমিশন বাণিজ্য এবং দুনীতির কারণে সরকারের এসব শুভ উদ্যোগ কাক্সিক্ষত সুফল দিতে পারছেনা। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মত প্রতিটি সরকারী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, ওষুধ-পথ্য ও সুযোগ-সুবিধার সুষ্ঠু ব্যবহার করতে নিয়মিত, কার্যকর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন