কোরবানীর ঈদ সামনে রেখে রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে অস্থায়ী পশুর হাটগুলো জমে উঠতে শুরু করেছে। ভারতীয় গরু আমদানী বন্ধ থাকা সত্ত্বেও দেশীয় খামার এবং কৃষকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়ার সরবরাহ আসায় ন্যায্যমূল্যে পশু কিনতে পারার আশায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে মানুষ। অন্যদিকে ভারতীয় গরু না আসায় গরু-ছাগলের খামারি ও পাইকাররাও পশু বিক্রিতে লোকসানের ঝুঁকিমুক্ত বলে মনে করছে। তবে এসব প্রত্যাশার মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায় ব্যাপক চাঁদাবাজি। দুই ঈদে ঘরমুখো মানুষদের জিম্মি করে গণপরিবহনে চাঁদাবাজি একটি অতি পরিচিত বিড়ম্বনা। কোরবানী ঈদে এই বিড়ম্বনা ঘরমুখো যাত্রী এবং পশুবাহী পরিবহনে পরিব্যাপ্ত হয়ে চাঁদাবাজির আকার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, লঞ্চঘাটে পরিবহন মালিক এবং লাখো মানুষ বিভিন্ন সংগঠনের নামে এবং রাজনৈতিক পরিচয়ধারী এক শ্রেণীর স্থানীয় ক্যাডারের চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। পরিবহন মালিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া বাড়িয়ে চাঁদার মাসুল পুষিয়ে নিলেও সব ধরনের চাঁদাবাজির দায় বহন করতে হয় সাধারণ মানুষকেই। সড়ক-মহাসড়কে, নৌপথে চলাচলকারী পশুবাহী ট্রাক ও ট্রলারগুলোতে চাঁদাবাজির উৎসবে মেতে ওঠা এসব উঠতি মাস্তান ও সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজদের লাগাম টানার যেন কেউ নেই।
গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথের চিত্র হচ্ছে, পশুবাহী ট্রাক হাটে ঢোকার আগেই দলবদ্ধ মাস্তানরা চাঁদার দাবীতে হামলে পড়ছে। চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিশেষ নিরাপত্তার কথা বললেও পুলিশকে তাদের দাবীকৃত হারে চাঁদা না দিলে নানা ব্যানারের দলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজির হাত থেকে বাঁচতে পারছেনা গরু-ছাগল বেপারীরা। কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ এবং দলীয় ক্যাডাররা যেন যোগসাজশ করেই চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দেয়ার পরও পশুবাহী ট্রাকগুলো নিয়ে তাদের পছন্দের হাটে যেতে পারছেনা গরু ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে হাটের ইজারাদারদের নিয়োগকৃত ক্যাডাররা তাদের নিজেদের হাটে যেতে বাধ্য করছে। এসব ঠেকাতে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সক্রিয় থাকলেও দলীয় পরিচয়ধারী ইজারাদারদের বেপরোয়া ক্যাডারদের দমানো যাচ্ছেনা। মহাসড়কগুলোতে ওভারলোডিং নিয়ন্ত্রণের নামেও বিভিন্ন ব্রীজের টোলপ্লাজা এবং রাস্তায় বসানো স্কেলে কারসাজির মাধ্যমে পশুবাহী ট্রাক থেকে বাড়তি টাকা আদায় করছে সংশ্লিষ্ট ইজারাদাররা। পদ্মার ভাঙ্গনে ফেরি সমস্যার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা পশুবাহী গাড়িগুলোকে ফেরি ধরতেও সিরিয়ালের নামে বড় ধরনের চাঁদা গুনতে হচ্ছে।
ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাঠানো বন্ধ করে দেয়ার পরও একসাথে এত বিপুল সংখ্যক কোরবানীর পশুর চাহিদা মেটানো আমাদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই মহতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পাশাপাশি কোরবানী সুলভ ও সহজলভ্য রাখতে সকল পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এক রিপোর্টে দেখা গেছে, এবারের কোরবানীর ঈদে গরু, মহিষ, ছাগল-ভেড়া মিলে প্রায় ৬৮ লাখ পশু ক্রয়-বিক্রয় হবে। কোরবানীর এই ঈদ সামনে রেখে দেশীয় অর্থনীতিতে অন্তত ২৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে বলে বাণিজ্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে বলা হয়েছে। এই বিপুল অর্থপ্রবাহের একটি অংশ চলে যাবে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের পকেটে। কোটি কোটি মানুষের ঘরে ফেরা এবং ৬৮ বা ৭০ লাখ পশু ক্রয়-বিক্রয়ের এই ঈদ উৎসবকে সফল করতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক এবং পশুর খামারি ও কৃষকদের ভূমিকা থাকলেও এসব চাঁদাবাজ ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কোন ভূমিকা নেই। প্রতিটি ঈদের আগেই সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর ঘোষণা দেয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে তার কোন প্রতিফলন দেখা যায়না। পথে পথে চাঁদাবাজি ছাড়াও মলমপার্টি, অজ্ঞানপার্টি, প্রতারক ও জালটাকার সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। এসব দৌরাত্ম্যসহ মহাসড়ক, ফেরিঘাট থেকে শুরু করে পশুর হাট পর্যন্ত পাইকার এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপর অনৈতিক চাঁদাবাজির খড়গ বন্ধ করা গেলে ঈদের আনন্দ আরো পরিপূর্ণ হতে পারতো। দেশের মানুষের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-কে নির্বিঘœ ও চাঁদাবাজিমুক্ত রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আরো সতর্ক নজরদারি এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন