শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

মো. সাইফুদ্দীন খালেদ | প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৭ এএম

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সর্ম্পক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কীভাবে তার দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তার আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে বা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন জীবন কাটে স্বস্থিতে। পক্ষান্তরে দ্রব্যমূল্য যদি অস্বাভাবিক হয় ও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন দুর্ভোগ ও অশান্তির শেষ থাকে না। রোজায় বেশি প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডাল ও খেজুরের দাম বেড়েছে। মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে বেড়েছে এলাচ, শুকনা মরিচ, রসুন ও আদার দাম। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন অন্ন। আর এ মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্নের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, তরকারি, চিনি, দুধ ইত্যাদি নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনের গতিকে অচল ও আড়ষ্ট করে তুলে।

চাল বা ভোজ্যতেলের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে কেনা কঠিন হয়ে পড়বে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দেশের অন্যতম সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ন্যায়সঙ্গত মূল্য বলতে বর্তমানে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায় না। অতীতের সেই কথাগুলো আজ আমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হয়। যেমন- শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এখন আর সে মূল্য আশা করা যায় না। এক সের লবণ এক পয়সা, এক পয়সায় এক সের দুধ, দু আনায় এক সের তেল, একটি লুঙ্গি এক টাকা এবং একটি সুতি শাড়ি দু টাকা- তা খুব বেশি দিনের কথা না হলেও এটা কেউ এখন আর আশা করে না। ব্রিটিশ শাসনামলেও আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য অনেকটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ছিল। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া জনগণকে হতাশার রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বাড়ছে বাসাভাড়া, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। সেই অনুপাতে বাড়ছে না মানুষের আয়। ফলে জীবনযাত্রার মানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়া মানেই দেশের বেশির ভাগ মানুষের ওপর চাপ পড়া। তাই সরকারকে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই শুধু নয়, কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে। তখন উৎপাদন বাড়বে, বাড়বে ক্রয়ক্ষমতা। আয় বাড়লে মূল্যস্ফীতির আঘাতও হয় সহনীয়।

কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুদদার প্রভৃতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ করা কঠিনতর হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে এবং মানুষকে অর্ধাহার ও অনাহারে দিন কাটাতে হয়। মানুষের একটু ভালোভাবে বাঁচার দাবি আজ সর্বত্র। কিন্তু বাস্তব পরস্থিতি তাদের প্রতিকূলে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমাকে অতিক্রম করে অশ্বগতিতে বেড়ে চলছে ব্যয়ের খাত। এরূপ হারে পানির বিল, গ্যাস বিল, জ্বালানি তেলের মূল্য ও দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত খরচ জনগণের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই মূল্যের এরূপ বৃদ্ধিতে অসহায় ও নিরূপায় হয়ে পড়েছে। অথচ, তারাই মূল্যবোধ দিয়ে সমাজকে ধরে রাখে; তারাই গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে। জনগণ আশা করছে, তাদের এরূপ অবস্থার উন্নতি হবে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসের মূল্য কমবে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। বাজারের ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে কি ব্যর্থ হচ্ছে- বিদ্যমান পরিস্থিতে এমন প্রশ্ন দাঁড়ায়।

অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বাজারে যাচ্ছেতাই কান্ডকীর্তি চালাতে না পারে, এ জন্য টিসিবিকে শক্তিশালী করার তাগিদ ইতোমধ্যে বহুবার নানা মহল থেেক এসেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আশানুরূপ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অর্থনীতির সূত্রমতে, উৎপাদন ব্যয় ছাড়াও জিনিসপত্রের দাম বাজারের চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূলে বহুবিধ কারণ রয়েছে। যেমন স্বার্থপরতা, অসাধু সমাজবিরোধী তৎপরতা, অর্থলোভী মানুষের অমানবিক আচরণ ইত্যাদি। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণে অর্থাৎ অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে আশানুরূপ ফসল উৎপাদিত না হলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। আবার কৃষি ও শিল্প কারখানাগুলোর উৎপাদনে সীমাবদ্ধ এবং বিদেশি মুদ্রার অভাবে পণ্যদ্রব্য চাহিদা পরিমাণ আমদানি করা সম্ভব না হলে চোরাকারবারি, মজুদদারি ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ গ্রহণ করে। তারা জিনিসের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে। ফলে দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়।

পণ্যমূল্য নির্ধারণে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ আইনের আওতায় নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ, চোরাকারবারি প্রতিরোধ, ফড়িয়া ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যেতে পারে। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় অথবা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ পদক্ষেপ নিতে পারে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কে আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ কেনাবেচা করলে তর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যবসায়ী বিশেষজ্ঞ কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করে এ অবস্থার উন্নতি করা যেতে পারে। ব্যবসায়ীদের নীতি-নেতিকতা, জবাবদিহি ও ইসলামসম্মত জনসেবামূলক ভূমিকা রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: আইনজীবী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন