করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতেই আমাদের লেজেগুবুরে অবস্থা হয়েছে। একটি অনিশ্চিত সংক্রামক ভাইরাসে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বাস্তবচিত্র দেখেছি। ঘরে অসুস্থ পিতামাতাকে ফেলে রেখে সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের পলায়ন দেখেছি। যাদের কামাই-রুজি, আদর স্নেহে বড় হয়ে উঠেছে সন্তানরা পিতা-মাতার লাশ গ্রহণ না করে তারা চ্যারিটেবল গ্রুপকে খবর দিয়ে সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার কী অদ্ভুত প্রাণান্ত চেষ্টাই না করেছে। যদিও মৃতদেহ থেকে ভাইরাস সংক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র হাঁচি-কাশির ড্রপলেট বা সংক্রমিত ব্যক্তির লালা থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কার কথা জানা যায়। করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর কয়েক সপ্তাহের ঘরোয়া চিকিৎসা ও বিশ্রামে তা সেরে গেছে অথবা করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর পর টেস্ট করে করোনা পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া গেলেও পরিবারের অন্য কারো মধ্যে সংক্রমিত না হওয়া বা কোনো রকম সিম্পটম না দেখা দেয়ার অসংখ্য উদাহরণ বাংলাদেশে দেখা গেছে। অথচ, করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃত ব্যক্তির পাশে একই বিছানায় থেকেছে, একই গ্লাসে পানি খেয়েছে, একই টয়লেট-বাথরুম শেয়ার করেও অন্যদের কিছু না হওয়ার উদাহরণ করোনাভাইরাসের অতিমাত্রায় সংক্রমণের প্রাথমিক প্রচলিত মিথ সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে।
বিশ্বের দেশে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের আঘাতে শত শত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কোথাও আমাদের দেশের মতো অবস্থা হয়নি, যেখানে দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। গত বছর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশে লকডাউন, শাটডাউনের মধ্যে প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে দুইশ’ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল, এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রতিদিন সাত হাজারের বেশি লোকের আক্রান্ত হওয়া এবং সরকারি হিসেবেই অর্ধশতাধিক মৃত্যুর দৃশ্য যেন মানুষের কাছে সহনীয় সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, করোনার অতিমারি শুরুর পর গত এক বছরে আমাদের সমাজমানসে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ করোনার ভয়-আতঙ্ককে অনেকটা জয় করতে পেরেছে। একইভাবে আমাদের প্রশাসন, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা সেক্টরে এই একবছরে যদি প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও উন্নয়ন সম্ভব হতো, তাহলে এখন হাসপাতালগুলোতে এমন হাহাকার ও আর্তনাদ শোনা যেত না। গত বছর করোনা সংক্রমণ অতিমারির শুরুতেই এই সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের করোনা টেস্ট করার উপর জোর দিতে বলেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন কমপক্ষে একলাখ মানুষের করোনা টেস্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় হলেও এখনো তা ২৫-৩০ হাজারের বেশি হচ্ছে না। এদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার এখন ২৫ থেকে ৩০ ভাগের উপরে চলে এসেছে। অর্থাৎ করোনা টেস্ট সীমিত রাখার পরও সরকারি হিসেবে প্রতিদিন ৭ হাজারের বেশি মানুষ করোনা সংক্রমিত হচ্ছে। এদের মধ্যে ১০ ভাগেরও যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাহলে প্রতিদিন ৭ শতাধিক করোনা রোগীর জন্য সিট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রণের শিকার হওয়া করোনা রোগীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণদের সংখ্যাই বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো রকম পূর্বলক্ষণ বা সিম্পটম ছাড়াই তারা খুব দ্রুত শ্বাস কষ্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে, দ্রুত অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়ায় এসব রোগীকে তাৎক্ষণিক অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে- হাইফ্লো নাজাল ও মনিটরিংয়ে রাখতে হচ্ছে। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগের যদি আইসিইউ বেডে দিতে হয় তাহলে প্রতিদিন অন্তত দেড় হাজার আইসিইউ বেড খালি হওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া এক রিপোর্ট অনুসারে সারাদেশের সব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৫৪৯টি। আমরা যদি এর সঙ্গে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতালে সমান সংখ্যক আইসিইউ বেডের সংখ্যা ধরে হিসাব করি তাহলেও দেশে আইসিইউ বেডের সংখ্যা এক হাজারের কিছু বেশি। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে প্রতিদিন ৭ হাজারের বেশি নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। বিশেষত মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই রেকর্ড ভেঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। হাসপাতালে শয্যা খালি না থাকায় সংকটাপন্ন রোগী নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে গাড়িতে বা রাস্তায় মারা যাচ্ছে রোগী। গত বছরের শুরুতে করোনার প্রথম ধাক্কায় যে অবস্থা দেখা দিয়েছিল, এক বছর পরও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
দেশ অর্থনৈতিকভাবে বহুদূর এগিয়ে গেছে, ক্ষমতাসীনরা এমন দাবি নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নের প্রাধান্য সামনে নিয়ে আনতে চেয়েছেন। দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসিবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এই করোনায় লাখ লাখ মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে গেছে, নিম্নবিত্ত শ্রেণির কর্মহীন মানুষ আয়-রোজগারের পথ হারিয়ে অতি দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে লাগামহীন বেড়েছে চাল-ডাল-তেলের মতো খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম। আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন জীবনবাস্তবতার মুখোমুখি কোটি কোটি মানুষ এখন অপুষ্টি এবং হাইপারটেনশনের শিকার, এদেরই একটি অংশ করোনা সংক্রমিত হয়ে দ্রুত ইমিউনোকম্প্রোমাইজড পরিস্থিতিতে পড়ছেন। তবে চলমান বাস্তবতাকে কোনো সরল অঙ্কে হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। কারণ সমাজের বিত্তশালী, প্রভাবশালীরাই বেশি সংখ্যক হারে করোনা সংক্রমিত হয়ে অক্সিজেন ও আইসিইউ ভেন্টিলেশনের জন্য যুদ্ধ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাজেট সবচেয়ে কম খরচ করে থাকে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর নাগরিকরা যেখানে স্বাস্থ্যসেবা খরচের শতকরা ৪৬ ভাগ সামর্থ্য অনুসারে নিজেদের পকেট থেকে পূরণ করে, সেখানে বাংলাদেশে এ হার ৭০ শতাংশের বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে খরচ করে সবচেয়ে কম। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম খরচ করে। আর যে খরচ দেখানো হয় তার বড় অংশই দুর্নীতি, লুটপাটে অপচয় হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য খাতে দেশের মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৫ শতাংশ খরচ করা উচিৎ। কিন্তু বাংলাদেশে এই করোনাকালীন বাস্তবতায়ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ৫ শতাংশের কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবটি ছিল সাধারণ বাস্তবতা অনুসারে। করোনাভাইরাসের অতিমারিতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে ভঙ্গুরতা ও দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে, সেখানে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে বাজেট আরো বেশি হওয়াই সঙ্গত। কিন্তু ২০২০-২১ সালের জাতীয় বাজেটের ৭.২ শতাংশ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
গত বছর ইউরোপ আমেরিকায় করোনা পেন্ডেমিকের শুরুতেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনায় সেখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থার শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। লাখ লাখ করোনারোগী ও হাজার হাজার সিরিয়াস পেশেন্টের ধাক্কা সামলাতে তাদের গৃহীত পদক্ষেপ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমরা তার কোনো প্রতিফলন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়ন পরিকল্পনা বা চলতি জাতীয় বাজেটে দেখতে পাইনি। গত এক বছরে দেশের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা এবং আইসিইউ বেড বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপই দৃশ্যমান হয়নি। এখন আবার করোনা অতিমারির তান্ডব যখন প্রতিদিনই নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, হাসপাতালগুলোতে শয্যাবৃদ্ধি ও আইসিইউ বেড বৃদ্ধির নতুন উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির প্রবণতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হতে শুরু করলেও একমাসের বেশি সময়ে করোনা রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় শয্যা, স্বাস্থ্যসেবা, অক্সিজেন সরবরাহ ও আইসিইউ পরিষেবা বৃদ্ধির আশাব্যঞ্জক চিত্র দৃশ্যমান হয়নি। ভালমানের একটি পরিপূর্ণ আইসিইউ বেড স্থাপন করতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানা যায়। চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। একহাজার কোটি টাকা খরচ করলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অন্তত দুই হাজার আইসিইউ বেড সংযুক্ত করা যেতো। দেশে কোটিপতির সংখ্যা একলাখের বেশি। প্রতিবছর দেশ থেকে নানাভাবে অর্ধলক্ষকোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে যাচ্ছে, আরেকদিকে নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত বলে পরিচিত সমাজের বৃহত্তর অংশ ক্রমে নিঃস্ব ও হতদরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে। জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্য ও মাথা গোঁজার ঠাঁই আগলে রাখাই যেখানে কঠিন, সেখানে বিলাসিতার ন্যূনতম চিন্তাও করা যায় না। কিন্তু রোগাক্রান্ত হয়ে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব-কর্পদকশূন্য হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া এদের সামনে আর কোনো উপায় থাকে না। অথচ, রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর করোনাভাইরাসের মতো অভূতপূর্ব মহামারি মোকাবেলায় বেসরকারি ও ব্যক্তিগত প্রয়াসের সুযোগ খুবই সীমিত। করোনাকালে পুরো মানব সভ্যতা মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করছে, ব্যক্তির ক্ষেত্রে সুস্বাস্থ্য এবং রাষ্ট্রের সঠিক ও পর্যাপ্ত স্বাস্থসেবা ব্যবস্থাপনা কতটা গুরুত্ববহ।
এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারি হিসেবেই প্রতিদিন মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৭০-৮০ জন। সরকারি পরিসংখ্যানের বাইরে এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হতে পারে বলে অনুমান করা যায়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়েসি তরতাজা মানুষগুলো হঠাৎ করেই চলে যাওয়ার অবিরাম মিছিলে কখন কে সামিল হবে এ নিয়ে আমাদের নাগরিক সমাজে এক মহা আতঙ্কের জন্ম হয়েছে। মানুষ আর সুদীর্ঘ ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে পারছে না। ধনী-গরীব সব শ্রেণির মানুষ এখন সুস্থভাবে বেঁচে থাকাকেই জীবনের পরম প্রাপ্তি হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে। তবে কতদিন-কতক্ষণ সুস্থ থাকতে পারবে, বেঁচে থাকতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা কারো হাতেই নেই। সমাজের ধনিক শ্রেণির একটি অংশ সামান্য অসুস্থতায় সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্ককের হাসপাতালে অ্যাপয়েন্টমমেন্ট লাগাতো। করোনাকালীন সতর্কতা, ভিসা ও ফ্লাইট বন্ধের কারণে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিজেকে সুস্থ রাখার সেই আত্মম্ভরিতা এখন আর কোনো কাজে লাগছে না। গত এক বছরে খ্যাত-অখ্যাত অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি। আমার বড়ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিউ ইয়র্কের হাসপাতালের আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে তিনদিন ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে গেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। সে সময়টাতে তার দেশে থাকার কথা ছিল। হঠাৎ করোনা পেন্ডেমিক শুরু হওয়ায় সব ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় তিনি দেশে আসতে পারেননি। ট্রাম্পের সময় আমেরিকায় এশীয়দের মর্যাদায় অনেকটা অবনমন ঘটলেও মার্কিন নাগরিক হিসেবে চিকিৎসা বা আইনগত সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সেখানে সাদা-কালো বা ডেমোগ্রাফিক পার্থক্য করার কোনো সুযোগ নেই। এটাই হচ্ছে উন্নয়ন, এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের সাধারণ ব্যবস্থা।
এই করোনাকালে বিশ্বের দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়া ও পিছিয়ে পড়ার নতুন মানদন্ড তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্টেটে করোনা ভ্যাকসিনেশনের শতকরা ৮০ ভাগের বেশি সফল হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। চীন, রাশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো করোনা ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে তাদের নাগরিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আমরা এখনো একটি উদ্বেগজনক অনিশ্চয়তায় হাবুডুবু খাচ্ছি। ভারতনির্ভর রাজনীতি ও কূটনীতি আমাদের জন্য এখন বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে। করোনা ভ্যাকসিনেশনে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে হলে দেশের প্রাপ্ত বষয়ষ্ক ৯০ ভাগ মানুষকে করোনা টিকার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। কোনো একক কোম্পানির কাছ থেকে ২০-৩০ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার প্রত্যাশা করা অনেক বড় বোকামি। চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশকে টিকা দিতে চেয়েছিল। সরকার নীতিগতভাবে চীনের সাথে এ বিষয়ে সম্মত হয়েছিল। ভারতের কথিত ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসির ফাঁদে পড়ে চীনের সাথে চুক্তি থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার উপর পূর্ণ ভরসা করে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ৩ কোটি ডোজ টিকার মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। প্রায় ৬শ কোটি টাকা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার পর ভারত সরকার বিদেশে টিকা রফতানি বন্ধের নির্দেশনা জারি করা হয়।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও চুক্তি অনুসারে টিকার সরবরাহ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ও স্টেটে করোনাকালীন লকডাউনের সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও বাংলাদেশে বেড়ে চলেছে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর মিছিল। চলতি বছরের মধ্যে দেশের সব মানুষকে করোনা টিকার আওতায় আনতে না পারলে, দেশের সব হাসপাতালে করোনা চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শয্যা ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করতে না পারলে তথাকথিত উন্নয়নের গল্প কল্পকথার ফানুস বলে চিহ্নিত হবে। করোনাকালীন লকডাউনে কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের শিক্ষাজীবন এবং অভিভাবকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা। এই করোনাকালেও এক শ্রেণির তথাকথিত নামিদামি স্কুল-কলেজ নামমাত্র অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখে পূর্ণ টিউশন ফি ও পরীক্ষা ফি আদায়ের জন্য অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। চলমান সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন