রমজান আমাদের সংযম শেখায়। এ সংযম আমাদের আত্মাকে শুধু পরিশুদ্ধ করে না, নানা রোগবালাই থেকে নিজেকে মুক্ত করার সুযোগ করে দেয়। রোজা শুধু আধ্যাত্মিক নয়, শারীরিক সুস্থতা আছে বলেই রোজার এত গুরুত্ব। উপবাস বা রোজা রোগ প্রতিরোধ ও রোগ সারাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। অনেকের ধারণা, উপবাস থাকলে স্বাস্থ্য খারাপ হয়। এ ধারণা ভুল, বরং নিয়মিত উপবাস স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।
হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে- মানবদেহের রক্ত সংবহনতন্ত্রে চর্বি বা কোলেস্টেরল জমা হয়ে হৃৎপিন্ডের ক্ষতি করে। শারীরের ধমনীগুলো হৃৎপিন্ড থেকে বিশুদ্ধ রক্ত বহন করে টিসুর দিকে নিয়ে যায় এবং শিরাগুলো টিসু থেকে দূষিত রক্ত বহন করে হৃৎপিন্ডে নিয়ে যায়। এভাবে রক্ত অনবরত চলাচল করে। রক্ত সংবহনতন্ত্রের ধমনী, শিরা-উপশিরার ভিতরে লাইনিংয়ে কোলেস্টেরল জমা হলে ঐগুলোর প্রশস্ততা কমিয়ে দেয়। ফলে ধমনী ও শিরা পর্যাপ্ত রক্ত বহন করতে পারে না। এতে রক্তের প্রবাহ চাপ বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া ক্রমান্বয়ে বন্ধ হতে থাকে। তখন বুকে ব্যথা হয়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। রোজা থাকার জন্য সারাদিন খাদ্য না খাওয়ায় এবং এক মাস এভাবে দিনে অভুক্ত থাকায় দেহে নতুন করে কোলেস্টেরল জমতে পারে না এবং আগের জমাকৃত কোলেস্টেরলগুলো কমে যায়। ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়।
মেদভুঁড়ি হ্রাস করে- মেদভুঁড়ি নিয়ে অনেকেই বিপাকে আছে। রোজা রাখলে দেহে ক্ষয় হয়। ফলে দেহের চর্বি ভেঙ্গে দেহের ক্ষয় পূরণের ব্যবস্থা হয়। এতে সারাদিন খাদ্য না খাওয়াতে নতুন করে চর্বি জমতে পারে না। এক মাস এভাবে দিনে অনাহারে থাকাতে মেদভুঁড়ি কমে যায়। কিন্তু ইফতারি ও রাতে খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে মেদভুঁড়ি কমবে না।
পেপটিক আলসার- খাওয়া দাওয়া বেশি করলে পেপটিক আলসার বৃদ্ধি পায়। রোজা থাকলে সারাদিন না খেয়ে থাকায় খাদ্যনালী, পাকস্থলী, যকৃৎ, পিত্তথলি, ক্ষুদ্রাযন্ত্র, হজমে সহায়ক গ্রন্থিগুলোর বিশ্রাম পায়। এতে পেপটিক আলসার রোগীর উপকার হয়।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে- সারাদিন না খেয়ে রাতে অল্প সময়ের মধ্যে ঘন ঘন খাওয়ার জন্য বিশেষ করে ছোলা, শরবত, পিয়াজু, শসাসহ বিভিন্ন রকম খাবার খাওয়াতে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
হজম ভাল করে- যাদের হজমে সমস্যা আছে তারা এক মাস রোজা রাখলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়। কারণ একটানা ১১ মাস সবসময় পাকস্থলি ও অন্যান্য গ্রন্থি হজমে ব্যস্ত থাকে। অপরদিকে, রোজা থাকার জন্য প্রতিদিন ৬ -৭ ঘন্টা পাকস্থলী, খাদ্যনালী, যকৃৎ পিত্তথলি, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, ডিউডেনাসসহ হজমে সহায়ক বিভিন্ন গ্রন্থির কোনো কাজ থাকে না, অর্থাৎ বিশ্রামে থাকে। পাকস্থলী বিশ্রামের পর সন্ধ্যায় ও রাতে পাকস্থলী খাদ্য পেয়ে নতুন উদ্যামে নতুন শক্তি নিয়ে হজম ক্রিয়ার অংশগ্রহণ করে। ফলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। যকৃৎ খাদ্য হজম ছাড়াও আরও ১৫ রকমের কাজ করে। ফলে যকৃৎ অবসাদগ্রস্থ হয়ে হজমকারক পিত্তরস ঠিকমত তৈরি করতে পারে না। না খেয়ে থাকলে যকৃতের ক্লান্তি দূর হয় এবং পিত্তরস নিঃসৃত করে হজমে সহায়তা করে। পাকস্থলীতে সামান্য একটু খাবার গেলেই হজমে নিয়োজিত সমস্ত গ্রন্থি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রক্ত বৃদ্ধি হয়- দেহে রক্তের প্রয়োজন হলে তখন এক প্রকার স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হাড়ের মজ্জাকে আন্দোলিত করে তোলে। অভুক্ত থাকাকালীন দেহে রক্তের পরিমাণ ও প্রবাহ কমে। ফলে হাড়ের মজ্জায় আন্দোলিত হয়ে রক্ত তৈরি হয়। রোজা থাকার জন্য পরে দেহে রক্তের পরিমাণ বাড়ে।
আমাশয় সেরে যায়- রোজা রাখার জন্য দিনে পেট খালি থাকে বলে যে সব ব্যাকটেরিয়া আমাশয় সৃষ্টি করে সে সব ব্যাকটেরিয়া খাদ্যের অনুপস্থিতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে আমাশয় সেরে যায়। অপরদিকে, ইফতারি ও সেহরিতে একটু উন্নতমানের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে দেহের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হয়।
সুতরাং আসুন সংযমের মাস রমজানে আমরা আমাদের রসনাকে সংযম করে সঠিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ রেখে বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদতে সচেষ্ট হই।
ডা. মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবাইল : ০১৭১৬ ২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন