২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হয়। সারা বিশ্বে ২০০২ সাল থেকে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হচ্ছে। আমরা কণ্ঠস্বর সম্পর্কে সচেতন নই। বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কণ্ঠ ও কণ্ঠনালির সমস্যা এবং সেই সঙ্গে কীভাবে কণ্ঠকে সুস্থ রাখা যায় তা জনগণকে জানানো। পারস্পরিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো কণ্ঠ বা কথা বলা। প্রত্যেকেরই নিজস্ব কন্ঠস্বর রয়েছে। কারো গলার স্বর মোটা, ভারী আবার কারো মাঝারী ধরণের কিংবা চিকন। ভিন্নতা লক্ষ করা যায় নারী ও পুরুষের কণ্ঠস্বরে। যাদের জোরে জোরে এবং প্রচুর কথা বলতে হয় তাদের প্রায়ই গলা বসে যায়, কণ্ঠস্বর প্রায় বন্ধ হয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজ বেরোয়। নেতা, মঞ্চ অভিনেতা, গায়ক-গায়িকা, ফেরিওয়ালা এবং এমনকি অনেক সময় শিক্ষকেরাও প্রায়ই এই সমস্যায় ভোগেন। তাই পেশাগতভাবে কন্ঠস্বর ব্যবহারকারীদের শব্দ উৎপাদনকারী কণ্ঠনালী ব্যবহারে যত্নবান হতে হবে। প্রতিবারের ন্যায় এবারের ২০২১ সালের বিশ্ব কন্ঠ দিবসের থিম হচ্ছে -“ওয়ান ওয়ার্লড: মেনি ভয়েস” অর্থাৎ এক বিশ্ব: বহু কণ্ঠস্বর।
শব্দযন্ত্র এবং কথা বলা :
আমাদের গলার সামনের দিকে শব্দযন্ত্র অবস্থিত। শব্দযন্ত্রে দুটি ভোকাল কর্ড বা কন্ঠনালী থাকে। এই নালী দুটির কম্পনের মাধ্যমে শব্দ তৈরী হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের দিনে ১০ লাখ বার কন্ঠনালী দুটির স্পর্শ ঘটে। এই কন্ঠনালী বিপুল ঘর্ষণে জর্জরিত হয়ে আঘাত প্রাপ্ত হলে প্রদাহ ঘটে। কথা বলার সময় অতিরিক্ত জোর প্রয়োগের কারণে স্বরতন্ত্রীতে সমস্যা হলে গলার স্বর ভেঙ্গে যায়। তখন স্বরতন্ত্রী ফুলে যায়, আশপাশে পানি জমে (ইডিমা) এবং কখনো ছোট গোটা বা নডিউলের মতো হতে পারে। তাই সুস্থ কন্ঠস্বর দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ।
কন্ঠনালীর সমস্যার লক্ষণ :
কন্ঠনালীর অসুখের লক্ষণ হলো গলা ব্যথা, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তণ; ফ্যাস ফ্যাস শব্দ/গলা ভাঙা ; কাশি, কিছু গিলতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বা গলা ভাঙ্গা তীব্র হতে পারে আবার দীর্ঘ মেয়াদী হতে পারে। যদি ঘন ঘন কন্ঠস্বরের পরিবর্তন বা গলা ভাঙ্গার সমস্যা হয় অথবা দুই সপ্তাহে ভালো না হয়, তবে অবশ্যই নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসক দেখাতে হবে। নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসকরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভোকাল কর্ড বা কন্ঠনালী পর্যবেক্ষন করে থাকেন। পদ্ধতি গুলো হচ্ছে: ইনডাইরেক্ট ল্যারিংগোসকপি, ডাইরেক্ট ল্যারিংগোসকপি, ভিডিও ল্যারিংগোসকপি।
কন্ঠনালীর তীব্র প্রদাহ এবং করণীয় :
কন্ঠনালীর তীব্র প্রদাহের প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া। ভাইরাস প্রদাহে কন্ঠনালী ফুলে গিয়ে কম্পনের সমস্যা সৃষ্টি করে, ফলে স্বর পরিবর্তন হয়। প্রচুর পরিমান পানি পান করলে এবং এমতাবস্থায় কন্ঠনালীকে বিশ্রাম দিলে এটা ভালো হয়ে যায়। এই অবস্থায় কণ্ঠস্বরের যত্ন দরকার। প্রথমেই চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে বিরত থাকতে হবে। ঠান্ডা লেগে যদি গলা বসে যায়, তবে কথা বলা বন্ধ করতে হবে বা কমিয়ে দিতে হবে। কারণ তীব্র প্রদাহ অবস্থায় যদি কেউ জোরে কথা বলে তা কন্ঠনালীর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি ফিসফিস করেও কথা বলবেন না তখন। ধূমপান গলার যেকোনো সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয় বা জটিল করে তোলে; তাই ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যাকটেরিয়া জনিত কন্ঠনালীর প্রদাহে এ্যান্টিবায়োটিক এর প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাথে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দিয়ে থাকেন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষধ খাওয়া যাবেনা। স্বরনালী বা ভোকাল কর্ডকে বাস্পস্নাত করতে বাস্প প্রবাহ শ্বাসের সঙ্গে টানা যেতে পারে। মেনথল ইনহেলেশন ভোকাল কর্ডকে কিছুটা আদ্রতা দিবে। একটি বাটিতে গরম পানি নিয়ে সেই পানিতে এক চিমটি মেনথলের দানা নিয়ে তারপর বাস্পটুকু শ্বাসের সঙ্গে টেনে নিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী কন্ঠনালীর প্রদাহ:
তীব্র প্রদাহ ঠিকমতো চিকিৎসা না করা হলে, দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ হতে পারে। চিকিৎসা সত্তে¡ও যদি কারও অনেকদিন ধরে গলা ভাঙ্গা থাকে, ওজন কমতে থাকে, কাশির সঙ্গে রক্ত গেলে এবং ধুমপানের ইতিহাস থাকলে সাবধান হতে হবে, কেননা তাহলে শব্দযন্ত্রের ক্যান্সার সন্দেহ করা হয়।
কণ্ঠনালির ক্যান্সার:
আমাদের দেশে গলার ক্যান্সার বা কণ্ঠনালির ক্যান্সারের প্রকোপ বেশি। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান কণ্ঠনালির ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। ধূমপান এর সাথে যদি কারো মধ্যপান এর অভ্যাস থাকে, তাহলে তার ক্ষেত্রে দ্বিগুণ ঝুকি বেড়ে যায়। স্বরের পরিবর্তন ২১ দিনের মধ্যে ভালো না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। ব্যক্তির রোগের ইতিহাস, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গলার ক্যান্সার বা কণ্ঠনালির ক্যান্সারকে মোটেও অবহেলা করা উচিত নয়। কণ্ঠনালির ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। এ রোগের সব ধরনের চিকিৎসা, যেমন-সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি আমাদের দেশেই রয়েছে।
কন্ঠনালীর অপব্যবহার করবেন না :
১) জনসমাবেশ / কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে জোরে কথা না বলা।
২) ঘাড় ও কানের মধ্যে ফোন চেপে ধরে কথা বললে ঘাড় ও শব্দযন্ত্রের মাংস পেশিতে টান লাগে। কারণ আমরা যখন কথা বলি, কন্ঠনালীর সঙ্গে আশে-পাশের মাংস পেশীরও সাহায্য লাগে। তাই মোবাইলে কথা বলার সময় খেয়াল রাখতে হবে বিষয়টা।
৩) জনসমাবেশ বা বড় লেকচার গ্যালারীতে ব্যবহৃত মাইক ছাড়া জোরে কথা বললে কন্ঠনালীর উপর বেশি চাপ পড়ে।
৪) অনেক সময় প্রচন্ড গরমের মধ্যে বাইরে থেকে এসেই হুট করেই আমরা ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করি, যা আমাদের গলার জন্য ক্ষতিকর। হঠাৎ ঠান্ডা পানি পান করলে গলা ভেঙে যেতে পারে, এতে কণ্ঠের স্বাভাবিক সুরের ব্যত্যয় ঘটে।
৫) কণ্ঠ সুস্থ রাখতে কিছু বদ-অভ্যাস পরিহার করতে হবে। বিশেষ করে ধূমপান গলার স্বর পরিবর্তন করে দিতে পারে। ধূমপানের কারণে কণ্ঠে বিভিন্ন রোগ দানা বাঁধে। কণ্ঠই যদি হয় জীবিকা চালানোর অবলম্বন, তাহলে ধূমপানসহ অন্যান্য মাদক সেবন থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।
গলার স্বরভাঙ্গাকে কখনই অবহেলা করবেন না। মনে রাখবেন স্বর / কন্ঠ অবশ্যই মহান সৃষ্টিকর্তার অনন্য উপহার।
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ (শাফী)
নাক-কান-গলা এবং হেড-নেক সার্জারী বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন