শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মায়ের অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা শুনলে মনোকষ্ট বাড়ে। বিশ্বাস করতে মন চায় না। মনে হয়, যা শুনেছি তা যেন মিথ্যা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটি যেন সত্য না হয়। সমকালীন সভ্যতা বা বিশ্ব চেহারার যে চাকচিক্য তা যেন বিশ্ববাসীর মনের প্রতিফলন নয়। মানুষের মধ্যে যে হাহাকার বিরাজ করছে তা যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ভনিতার আবরণে।

গত ২ এপ্রিল টেলিভিশনে একটি ফুটফুটে শিশুর ছবিসহ ঘটনা শুনে আৎকে উঠলাম। জানা গেল, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮ মাসের শিশুকন্যাকে রেখে পালিয়েছে এক সৌদি প্রবাসী নারী। আরো জানা গেল, ওই দিন সকালে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর আগমনী টার্মিনালে একটি ট্রলি থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করেছে বিমানবন্দর আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন। ১ এপ্রিল দিবাগত রাত ২টায় সৌদি আরব থেকে ওই শিশুকে নিয়ে ঢাকায় আসেন সেই নারী। সারারাত বিমানবন্দরে অপেক্ষার পর সকাল ৮টায় শিশুটিকে ফেলে পালিয়ে যান তিনি। নিষ্ঠুরতা কত গভীর ও মর্মান্তিক পর্যায়ে গেলে এমনটি ঘটে, সেটা সহজেই অনুমেয়। মানুষের কোনো আইন সন্তানকে মা থেকে আলাদা করতে পারে না, যা পারছে এই নিষ্ঠুরতা। এটি অমানবিক সামাজের প্রতিচ্ছবি উৎকটভাবে প্রকাশ করছে। শিশুসন্তানকে মা-বাবা হত্যা করছে; যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষ্ঠুরতা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, এর কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। প্রতিকার বাঞ্ছনীয়। তা না হলে একটা সময় জঙ্গলে বসবাসকারী পশু-প্রাণী ও মানুষে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

অভাবের তাড়নায় সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার কাহিনী শোনা যায়। যে নারী সৌদি আরবে চাকরি করে শিশুসন্তানসহ দেশে ফিরেছেন; তার অর্থনৈতিকভাবে অভাবী থাকার কথা নয়। পত্রিকান্তরে জানা যায়, একই ফ্লাইটে আসা আসমা নামে এক তরুণী পুলিশকে জানিয়েছে, শিশুটির মা সৌদি আরবে কাজের জন্য গিয়েছিল, সেখানে এক ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের ঘরে এই সন্তানের জন্ম। তবে দেশে ফেরার আগেই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। তাই সন্তান নিয়ে সে কোথায় যাবে দ্বিধায় ছিল। প্লেনে কয়েকবার কান্নাকাটিও করেছে। আমাদের সমাজে এক ধরনের পাষন্ড রয়েছে, যারা কন্যাসন্তানকে বোঝা মনে করে। এ কারণেই হয়তো পিতা-মাতা কন্যাশিশুকে গ্রহণ করতে চায় না।
পিতা-মাতা অতিকষ্টে সন্তান লালনপালন করে। একটি সন্তানের জন্মের পেছনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। পিতা সন্তানকে ফেলে গেলে, অনেকের কাছে বিষয়টি তেমন অবাক করে না। কিন্তু গর্ভধারিণী মা যখন শিশুসন্তান ফেলে চলে যায়, সেটি অবাক করার মতো ঘটনা বৈকি! বিমানবন্দরে শিশুসন্তান ফেলে যাওয়া অভাবের তাড়নায় নয় বরং মনে হলো সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে মা তার সন্তান ফেলে চলে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হতেই পারে, এ জন্য একটি শিশু পিতা-মাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে, এটা কেমন কথা? সংশ্লিষ্ট মাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে রাষ্ট্র কেন এখানে এগিয়ে আসবে না? বাংলাদেশে বা বিশ্বে সংঘটিত আরো ঘটনার সাথে এ নিষ্ঠুরতার পেছনে পিতা-মাতা দু’জনই দায়ী, তবে এ ধরনের ঘটনার পরও মানুষ দাবি করে যে তারা সভ্যতার অংশীদার।

পুলিশ বলেছে, সংশ্লিষ্ট মায়ের সন্ধান তারা পেয়েছে। এই অদায়িত্বশীল মায়ের বক্তব্য বিশ্ববাসীর শোনা দরকার। তাকে আইনের আওতায় আনা দরকার; ভবিষ্যতে যা এমন দায়িত্বহীনতার বিচারের দৃষ্টান্ত হতে পারে। দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়েই মানুষের পথচলা। যে চলে না; সে নিজে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা করে এবং এ প্রতারণার ফল ভোগ করতে হয় গোটা সমাজ ও জাতিকে। সমাজের প্রতিবন্ধকতার জন্যও অনেক সময় মানুষ অসহায় হয়ে নিজ ইচ্ছার বিপরীতে অপরাধের অংশীদার হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট মা হয়তো শিশুসন্তানটিকে নিজের জন্য একটি প্রতিবন্ধক মনে করেছেন। ঘটনাটি এ রকম হতে পারে যে, ‘মা’ স্বামীর নিকট প্রত্যাখ্যাত বা প্রতারিত হওয়ার পর পরিবার এবং সমাজের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কায় নিজের গর্ভজাত সন্তানের সাথে এই নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। অর্থাৎ শিশুটিকে ফেলে চলে গিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে(!) অথচ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় মাতা-পিতা বা সমাজ ভিকটিম না হয়ে ভিকটিম হলো একটি নিষ্পাপ শিশু। এই শিশুটি একদিন জানতে ও বুঝতে পারবে যে, এই পৃথিবীটা কতটা নিষ্ঠুর এবং সমাজ কত কুৎসিত!

অনেক পুলিশ সদস্যের নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ এবং দুর্বলের প্রতি আইনের অপপ্রয়োগ পুরো বাহিনীকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। পুলিশকে গুণমুখী করতে আধুনিক পুলিশ বাহিনীর সংস্কারক রবার্ট পিল এ মর্মে ৯টি নীতিমালা প্রদান করেন। পুলিশকে আধুনিক ও গণমুখী করতে তিনি বলেন, ‘পুলিশই জনগণ এবং জনগণই পুলিশ’ এবং আরো বলেন, ‘পুলিশের পারদর্শিতা নির্ভর করে জনগণের সন্তোষ্টির ওপর।’ অথচ মূলত বাংলাদেশে পুলিশ জনগণের সন্তোষ্টি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনের কারণ হলো, নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ক্ষমতাসীনরা সবসময় পুলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে সরকার পুলিশকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করায়। মিথ্যা মামলা, মিথ্যা মামলায় রিমান্ড, মিথ্যা চার্জশিট প্রদানের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করার কারণে এই বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য পুলিশ বিভাগে কর্মরত উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাই বেশি দায়ী। অথচ, পুলিশ যে মানবিক আচরণ করে তারও প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘মা’ যেখানে শিশু বাচ্চাকে রেখে পালিয়ে গেল সেখানে বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশই শিশুটিকে রক্ষায় এগিয়ে এলো, নতুবা অবহেলা অযত্নে শিশুটির মৃত্যুও হতে পারত। আল্লাহর রহমতে বেঁচে থাকলেও শিশুটি হয়তো জানতে পারবে না যে, তার মা তার প্রতি কীরূপ নিষ্ঠুর আচরণ করে তাকে বিমানবন্দরে রেখে পালিয়ে গেছে। জানতে পারলে হয়তো তার মনে হবে, মায়ের কাছে সে ছিল অবাঞ্ছিত।

ভারত উপমহাদেশে পুলিশ আগেও ছিল, কিন্তু ১৮৬১ সালে ‘দ্য পুলিশ অ্যাক্ট, ১৮৬১’ আইন প্রণয়ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সরকার পুলিশকে মানবিক আচরণে গড়ে তুলতে পারেনি, বরং পুলিশ ব্যবহৃত হয়েছে লাঠিয়াল হিসেবে। ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের’ উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির মানবিক আচরণে পরিস্ফুটিত হোক এটা এখন জাতির প্রত্যাশা। পুলিশের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। বিভিন্ন গবেষকের গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, এক শ্রেণির মানুষ ভিকটিম হলেও থানায় মামলা করতে যায় না। মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতা এই যে, মামলা করলেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পুলিশি হয়রানি হতে হয়। সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে নাজেহাল হবে না; এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনই হতে হবে পুলিশের একমাত্র কর্তব্য। সরকারের উচিত হবে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার না করে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা। তবেই পুলিশ একটি কার্যকর গণমুখী বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন