দেশের দক্ষিণাঞ্চলের তরমুজের চাহিদার বেশির ভাগই মিটানো হয় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের তরমুজ দিয়ে। কিন্তু বিগত তিন বছর একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে তরমুজ উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। চলতি বছরে এ তরমুজের ফলনে এসেছে সব চেয়ে বড় বিপর্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তরমুজ আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। শুরুর দিকে ভালো ফলনে কৃষকদের মনে বড় আশার আলো জ¦লে উঠলেও শেষের দিকে এসে তা হতাশায় পরিনত হয়েছে। চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত খরার কারনে তরমুজের আকার অপেক্ষাকিত ছোট হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এ অঞ্চলেরর তরমুজ চাষীরা। শত শত একর জমিতে তরমুজ পঁচে গেলেও বিক্রি করার মত পাইকার না পেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। আর এ সমস্যাকে জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বলছেন কৃষিবিদরা। এখনই খরা সহিষ্ণ তরমুজের বীজ উদ্ভাবন তাগিদ তাদের। সেচ সুবিধা, সময়মত বৃষ্টি না হওয়ায় ও কৃষি বিভাগের পর্যাপ্ত সহযোগিতা এবং তদারকি না থাকায় ভালো ফলন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন চাষারীরা।
সরজমিনে সুবর্ণচর উপজেলার চরওয়াপদা, চরবাটা, চরজুবলী, চরজব্বার, চরক্লার্ক ও মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের তরমুজ ক্ষেত ঘুরে চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত দেড় শতকের বেশি সময় ধরে রসালো এই ফলটির চাষ করে আসছে সুবর্ণচরের কৃষকরা। কিন্তু গত ২-৩ বছর ধরে উপজেলায় তরমুজের আকার ছোট হতে শুরু করে। আর চলতি মৌসুমে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যেখানে স্বাভাবিকভাবে একটি তরমুজের ওজন ৯-১০ কেজি বা তারও বেশি হতো, বর্তমানে সেখানে একটি জমির বেশির ভাগ তরমুজের ওজন দেড় থেকে দুই কেজির বেশি হচ্ছে না। এক একর জমিতে তরমুজ চাষে খরচ হয় প্রায় ৪০-৫০হাজার টাকা। কিন্তু তরমুজের আকার ছোট হওয়ায় ওই এক একর জমিতে যে ফলন হয়েছে তা ১০হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারছে না চাষীরা। যার ফলে চাষের খরচ তুলতে না ফারায় তরমুজ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে উপজেলার কৃষকরা।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এঅঞ্চলের তরমুজ বিক্রি হচ্ছে জেলা শহর মাইজদী, চৌমুহনী, খাসেরহাট, হারিছ চৌধুরীর হাট, সোনাপুর, একলাশপুর, কবিরহাট, করমবক্স বাজার, ভূঁইয়ারহাট, কালামুন্সিসহ বিভিন্ন হাট বাজারগুলোতে। আকার অনুসারে প্রতিটি তরমুজ ১০, ৩০ ও ৫০টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। একটু বড় সাইজেরগুলো ৬০,৭০টাকা থেকে ১’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে তার সংখ্যা অনেক কম। বাজারে বড় তরমুজ না পেয়ে ক্রেতারাও হতাশ।
খাসেরহাট বাজারে তরমুজ ক্রয় করতে আসা জহির উদ্দিন বলেন, এ বছর বাজারে বড় সাইজের তরমুজ নেই বললে চলে। সুবর্ণচরের তরমুজের ভালো কদর ছিল। সাইজেও এ তরমুজগুলো ছিল বড়। কিন্তু আজ তরমুজ ক্রয় করতে এসে আমি পুরোই হতাশ হয়ে পড়লাম। যতদূর দেখলাম প্রতিটি তরমুজের ওজন ১ থেকে ৪ কেজির বেশি হবে না।
সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের উত্তর কচ্চপ্রিয়া গ্রামের তরমুজ চাষী রফিক উল্যাহ জানান, আমি কয়েক বছর যাবত তরমুজ চাষ করে আসছি। গত বছরও এক একর জমিতে তরমুজ চাষ করি, যাতে খরচ হয়েছিল ৪০ হাজার টাকা, আর বিক্রি করে ছিলাম ১লাখ টাকা। আর এ বছর আমি দুই একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। খরচ হয়েছে প্রায় ১লাখ ২০হাজার টাকা। কিন্তু অতিরিক্ত খরা, বৃষ্টি ও পোকার আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। আর আবহাওয়া অনুকুলে না থাকায় তরমুজের আকার ছোট হয়ে গেছে। শুরুর দিকে ভালো ফলনের সম্ভবনা থাকলেও এখন আর তা নেই। তরমুজ উৎপাদন করতে হলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জমিতে অন্তত ৪-৫বার পানি সেচ দিতে হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় জমিতে পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একই অবস্থা ওই এলাকার তরমুজ চাষী দ্বীন মোহাম্মদ, আলমগীর হোসেন, হারুন ও জাফর আহমদের। তারা বলেন, এ বছরের পর আর তরমুজ চাষ করবেন না। আগামী মৌসুমে তরমুজ ক্ষেতে অন্য কোন শস্য চাষাবাদ করবেন।
একই গ্রামের চাষী বাবুল জানান, গত ৩মাস আগে ১০একর জমিতে আগাম তরমুজ চাষ করেছি। ক্ষেতে পরিচর্যার পাশাপাশি নিয়মিত সার পানিসহ কিটনাশক ওষধ প্রয়োগ করি। কয়েকটি ক্ষেতে তরমুজের ফলন মোটামুটি হলেও বেশির ভাগ ক্ষেতের অবস্থা খুবই খারাপ। দুই ধাপে বিভিন্ন ক্ষেত থেকে তরমুজ বিক্রি করলেও উৎপাদন খরচের দশ ভাগও তুলতে পারিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৯ সাল থেকে জেলায় কমতে শুরু করেছে তরমুজের আবাদ। ২০১৯ সালে জেলায় তরমুজ আবাদ হয়েছিল ৯২৫০, ২০২০ সালে তা কমে হয়েছে ৩২৮৫, আর তা চলতি বছর কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৪৮৯ হেক্টর জমিতে।
পিকেএসএফ কৃষিবিদ শিবভ্রত ভৌমিক বলেন, বিগত কয়েক বছর প্রাকৃতিক দূর্যোগ চরম আকার ধারণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এ অঞ্চলের কৃষিতে। তাই এখনই পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী করেন তিনি।
সুবর্ণচর উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ জানান, সুবর্ণচর বিশাল এলাকায় হওয়ায় এবং আমাদের জনবল সংকটের কারণে সময় মতো সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয় না। তবুও চাষীদেরকে পরামর্শ দিয়েছি তরমুজ চাষাবাদের জন্য। এর পরও কোন চাষীর সমস্যা হলে আমার সাথে যোগাযোগ করলে আমি সহযোগীতা করবো। আমাদের জনবল দরকার ছিল ৪০জন, আছে মাত্র ১২ জন। উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১৩শ ৯৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শহিদুল হক জানান, তরমুজের আয়াতন ছোট হওয়ার বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে শুনেছি। প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় কৃষককে পরামর্শ দেওয়াসহ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। চরাঞ্চলের কৃষকদের চাষাবাদের জন্য সবধরনের সহযোগীতা ও সমস্যাগুলো চিহিৃত করে সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে। কিটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে কৃষি বিভাগ কাজ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন