এ বছরের কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সব ধরনের পশুর চামড়ার দাম ৫ থেকে ১০ টাকা কমিয়ে এ মূল্য নির্ধারণ করেছেন তারা। এ বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৫০ টাকা এবং ছাগলের চামড়ার দাম ২০ টাকা ধরা হয়েছে। ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৮৫ টাকা। এই দাম কমাতে কমাতে এ বছর ৫০ টাকায় নামানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন এবং দেশে লবণের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা এ দাম স্থির করেছেন। চামড়ার দাম কমানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের এ অজুহাত যে সঠিক নয়, তা পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যদিকে লবণের দাম বৃদ্ধির যে অজুহাত ব্যবসায়ীরা দিচ্ছেন, এ খরচ তাদের পকেট থেকে যায় না। সাধারণত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনার পরপরই তাতে লবণ দিয়ে থাকেন। এ খরচ তাদেরই মেটাতে হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকরা যে উসিলা দিয়ে চামড়ার মূল্য কম ধার্য করেছেন, তা একেবারেই বাস্তবতার পরিপন্থী এবং সঠিক নয়। এটা অনেকটা তাদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
চামড়াশিল্প ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর কোরবানির সময় গড়ে প্রায় এক কোটি চামড়া সংগ্রহ করেন। এটি দেশের মোট চামড়ার প্রায় ৬০ শতাংশ। বাকি চামড়া তারা সারা বছর ধরে সংগ্রহ করেন। কোরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ সাধারণত মাদরাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং এবং সমাজের গরীব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। চামড়ার দাম কমিয়ে দিলে এসব অসহায়-দুস্থ মানুষের ভাগে টাকা কম পড়ে। বলা যায়, তাদের হকের অর্থ কমে যায়। এ বছর ব্যবসায়ীরা যে দাম নির্ধারণ করেছেন, তা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এর পেছনে ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করছে। প্রথমত, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ট্যানারি শিল্প হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর না করায় প্রতিদিন সরকারকে ১০ হাজার টাকা করে যে জরিমানা দিতে হচ্ছে, তা উসুল করার জন্য চামড়ার দাম কমিয়ে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, চামড়া পাচারের পথ প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের চামড়া বিশ্বে এক নম্বর। এমনকি যে ভারত চামড়া রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে, তার চামড়ার চেয়ে অধিক উন্নতমানের। যেখানে ভারতের গরুর নিম্নমানের চামড়ার মূল্য প্রতি বর্গফুট ৯০ টাকা, সেখানে বাংলাদেশের চামড়ার মূল্য তার প্রায় অর্ধেক নির্ধারণ করার অর্থ পাচারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। স্বাভাবিকভাবেই খুচরা থেকে মাঝারি এমনকি বড় ব্যবসায়ীরা যেখানে বেশি দামে চামড়া বিক্রি করতে পারবে সেখানেই বিক্রি করবে। তাদের জন্য সহজ রাস্তা হচ্ছে ভারতে পাচার করা। গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ট্যানারির মালিকরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করায় চামড়া পাচারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য সীমান্ত জেলাগুলোতে ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে চামড়া কেনার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। এ কথা এখন বলতেই হচ্ছে, দেশের প্রধান রপ্তানিশিল্প গার্মেন্ট খাতের মতোই চামড়া খাতটিকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। আমরা দেখেছি, চক্রান্ত করে পোশাক শিল্পকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে তোলা হচ্ছে। শত শত কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। চামড়া শিল্পকেও একইভাবে নানা বাহানায় ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তা না হলে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য স্থিতিশীল, সরকারি সহায়তাসহ সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূল থাকা সত্ত্বেও ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকরা কেন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে চামড়ার মূল্য কমাবে? তাদের এ ধরনের মানসিকতা যে চামড়া শিল্পকে রুগ্ন করে তুলবে, তাতে সন্দেহ নেই।
দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত চামড়া শিল্প নিয়ে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের আভাস একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক ও উদ্বেগজনক। আমরা মনে করি, চামড়া কেনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে একটি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এতে চামড়া পাচার যেমন বন্ধ হবে, তেমনি চামড়া বিক্রেতারা ন্যায্যমূল্য পাবে। চামড়া শিল্পও গতিশীল হয়ে উঠবে। ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকদেরও অতি মুনাফালোভী না হয়ে মানবিক হওয়া উচিত। এটা তাদের অজানা নয়, কোরবানির চামড়ার অর্থ অসহায়, দুস্থ, এতিম ও দীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয় হয়। সচেতন নাগরিক হিসেবে বছরের এই একটা সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা আশা করব, চামড়ার ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে সংশ্লিষ্টরা বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখবেন। একই সঙ্গে সীমান্ত পথে চামড়া পাচার রহিত করতে হবে। সীমান্তে কড়াকড়ি করতে হবে, যাতে একটি চামড়াও ভারতে পাচার হয়ে না যায়। আইন-শৃংখলা বাহিনী ও বিজিবিকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন