শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দিনে দিনে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নদী

আলম শামস | প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিলো বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যাা ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে উপনদী ও শাখানদীর মোট সংখ্যা ২২৫। তবে নদী, উপনদী ও শাখানদীর মোট সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। একটি নদী থেকে বহু নদী সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোনো কোনো নদী থেকে খাল বা ছড়া উৎপন্ন হয়েছে। এগুলোও প্রাকৃতিক নদীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন- কর্ণফুলী নদী। মোহনা থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত এই নদীতে অন্তত ২৪-২৫টি ছোটবড় উপনদী এসে মিশেছে। এই হিসাব থেকে অনুমান করলে বাংলাদেশকে হাজার নদীর দেশ বলা যেতে পারে। যশোর, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে রয়েছে অজস্র নদী। এসব নদীর মধ্যে অনেক নদীর নামকরণও ঠিকমত হয়নি। আবার কোনো কোনো নদীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন নাম রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান নদী পাঁচটি: যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, পশুর ও কর্ণফুলী। এরপর আসে তিস্তা, গড়াই, মধুমতী, রূপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, কীর্তনখোলা, বিষখালী ইত্যাদি

নদীমার্তৃক দেশ বাংলাদেশ। ভারতের ফারাক্কা ও গজলডোবার বাঁধ ছাড়াও উজানে তৈরি করা ৪০টি ড্যাম ও ব্যারাজ পানির গতি পরিবর্তন করায় পানির অভাবে বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদীগুলো বিলীন হতে চলেছে। নদী হারানোয় প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে ভূ-প্রকৃতি। এই গ্রীষ্মের দাবদাহে ‘যে নদী মরুপথে’ উপন্যাসের মতোই বহু নদীতে এখন ধু-ধু বালুচর।

আদি যুগে সহজ যোগাযোগের কারণেই নদীতীরে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সত্তরের দশকেও নদীপথে পণ্য পরিবহন হতো বেশি। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারতের বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে নেয়ায় এই চার দশকে ১৬ হাজার কিলোমিটার নদীপথ কমে গেছে। রাজশাহী অঞ্চলে দিকে তাকালে দেখা যায়, বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন ড্যাম-ব্যারাজের কবলে পড়ে নদীগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ, জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে এ কারণে। নদ-নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে নৌপথ বন্ধ হওয়ায় মাঝিমাল্লারা কাজ হারিয়েছে। অর্ধশত প্রজাতির মাছ হারিয়েছে অস্তিত্ব। আর জেলেরা বদল করেছে তাদের পেশা।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহিত নদীর সংখ্যা ৫৪টি বলা হলেও অনেকের মতে, এ সংখ্যা ৯৭টি। নদীর স্রোতধারা আগের মতো নেই। তবে বর্ষাকালে প্রবাহ লক্ষ করা যায়। এমন ৪৩টি নদীর নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে, যা যৌথ নদী কমিশনের তালিকায় নেই। ভারত সকল রীতিনীতি উপেক্ষা করে অভিন্ন নদীগুলোর ওপর একতরফাভাবে অসংখ্য ড্যাম-ব্যারাজ নির্মাণ করে এসব নদীর দফা রফা করে ফেলেছে। নদীগুলোয় বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও প্রায় সারা বছর থাকে শুকনো। অনেক খরস্রোতা নদী নর্দমার নাম নিয়ে বেঁচে আছে। কিছু আছে বইয়ের পাতায় আর মানচিত্রে। নদীর বুকে নৌকা নয়, চলে চাষাবাদ। উত্তরের দেড় হাজারের বেশি বিলের মধ্যে হাজারখানেক বিলই অস্তিত্ব সংকটে। নদী ও বিলের কিছু অংশজুড়ে আবাদ হয় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের। আবাদি জমি বাড়ায় ফসল পেলেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব মারাত্মক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ কিংবা ভারতে সবচেয়ে আলোচিত নদীর নাম নিঃসন্দেহে ভারতে গঙ্গা আর বাংলাদেশে পদ্মা। হিমালয় পর্বতমালার গাঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে যাত্রা শুরু করে ভারত অংশে গঙ্গা আর বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের মনোহরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি জেলা পেরিয়ে উত্তর দিক থেকে আসা যমুনাকে গোয়ালন্দ নামক স্থানে ধারণ করে চাঁদপুরের মোহনায় মিলিত হয়েছে পদ্মা নাম নিয়ে। চাঁপাই থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার। এ দীর্ঘ পথচলা পদ্মার রয়েছে একটি উপনদী মহানন্দা আর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদনদী। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে যার সংখ্যা ষাটটিরও বেশি। অবশ্য অধিকাংশ এখন বিলুপ্ত ভারতের আগ্রাসী পানিনীতির কারণে।

উত্তরের রংপুর বিভাগের ৮ জেলা গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপদাহে জ্বলছে। পুকুর-খাল-বিল সবকিছু শুকিয়ে গেছে। ভারত কর্তৃক নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে এ অঞ্চলের তিস্তা, মহানন্দা, আত্রাই, পুনর্ভবা, করতোয়াসহ সব বড় নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। খরস্রোতা এসব নদী এখন খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। ছোট ছোট শাখা নদীর অস্তিত্বই চোখে পড়ে না। এদিকে দিনেরাতে প্রচন্ড তাপদাহে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া এতটাই বৈরী হয়ে পড়েছে যে, দিনের বেলা সূর্যের প্রখর তাপে মাটি থেকে যেন বাষ্প উঠছে। অনাবৃষ্টি আর প্রচন্ড খরার কারণে এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক ফসল ইরি-বোরো আবাদ রক্ষায় সেচ খরচসহ সামগ্রিক খরচ বহুলাংশে বেড়ে গেছে। নদনদী-খালবিল পানিশূন্য হয়ে পড়ায় মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। দিনাজপুরের পুনর্ভবা, আত্রাই, নীলফামারীর তিস্তা, পঞ্চগড়ের মহানন্দা, বগুড়ার করতোয়া, ঢেপা, গর্ভেশ্বরী, তুলাই, কাঁকড়া, ইছামতি, ছোট যমুনা, তুলসীঙ্গা, টাঙ্গনসহ অসংখ্য নদী রয়েছে। নদীগুলোর অধিকাংশেরই উৎসস্থল হিমালয় পর্বত। বর্ষাকালে এসকল নদী ফুলে ফেঁপে এ অঞ্চলের মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯টি নদীর দৈর্ঘ্য ৭২৮ কিলোমিটার, যার একটিতেও পানি নেই।

সুরমা-কুশিয়ারা নিয়ে সিলেট অঞ্চল। শতাধিক নদী সুরমা-কুশিয়ারায় মিলিত হয়েছে। কিন্তু নদীগুলো আজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। উজানে বাঁধ, পাশে কল-কারখানা, ময়লা-আবর্জনা, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, দখল-দূষণ, পাহাড়-টিলা কাটার কারণে নদীগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদীই ভারত থেকে এসেছে, যা আন্তঃসীমান্ত নদী নামে পরিচিত। সকল নদীই সুরমা ও কুশিয়ারায় মিলিত হয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ নদীতেই বর্ষা মৌসুমে পানি থাকে। তবে ফাল্গুন-চৈত্র মাসের দিকে পানি কমতে শুরু করে, তখন নদীতে নৌযান চলাচলা করা কঠিন হয়ে পড়ে। খুলনা বিভাগের মাগুরা জেলার ৬টি নদী শুকিয়ে যাওয়ায় জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য পরিবেশের মারাত্মক হুমকিসহ সেচ কার্যক্রম চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারতের উজান থেকে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করায় মাগুরা জেলাসহ এর আশে পাশের এলাকায় ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৬টি নদী শুকিয়ে গেছে। বর্তমানে নদীতে কৃষকরা আবাদ করছে ধান। ফলে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে নদীগুলো। নাব্য হারানোর কারণে নদীবক্ষে বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে জেগে উঠেছে চর। এখানকার নদীগুলো হচ্ছে নবগঙ্গা, কুমার, ফটকি, চিত্রা, গড়াই ও মধুমতি। তাছাড়া এসব নদী সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী খালের মাধ্যমে হাজার হাজার হেক্টর জমির সেচ কার্যক্রম নির্ভরশীল। নদীগুলোর পানি প্রবাহ কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসায় অনেক এলাকায় সেচ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে দেখা দিয়েছে পণ্য পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা। দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাঠির রূপসী বাংলার কবি জীবননানন্দ দাশের ঐতিহ্যবাহী ধানসিঁড়ি, পোনা ও জাঙ্গালিয়াসহ একসময়ের খরস্রোতা নদীগুলো বেপরোয়া দখল-দূষণে, নাব্য সঙ্কটে দিনে দিনে মরে যাচ্ছে। এখন নদীগুলো মরা খালে পরিণত হয়েছে, অনেকগুলো আবার নালায় পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি-যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা বিশেষভাবে নদীকেন্দ্রিক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ব্যবস্থার ওপর এখনও দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। এ পথে একইহারে পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। নৌপথে সড়ক ও রেলপথের চেয়ে অত্যন্ত স্বল্প খরচে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন সম্ভব। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতা ও পরিবর্তনের কারণে নদী, নদীকেন্দ্রিক জীবন, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কীভাবে এ হুমকি মোকাবিলা করা যাবে, সেটা আমাদের ভাবতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন