প্রচন্ড তাপদাহ বা হিটশকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইরি-বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে চর ও হাওড়ঞ্চলে এর প্রভাব বেশি হলেও অধিকতর উর্বর এলাকা হিসাবে চিহ্নিত দিনাজপুরে ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি চোখে পড়ছে না। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদেরকে তাপদাহের চেয়েও বেশি আতঙ্কিত করে রেখেছে ব্রাশ ফায়ার (এক ধরনের প্রকার আক্রমণ) রোগের। কৃষি বিভাগও বিষয়টি নিয়ে দুঃশ্চিন্তায়।
গত আমন মওসুমের শেষ মুহূর্তে এই ব্রাশ ফায়ারের কারণে কাঠারী (চিকন) ধানের ৭০ শতাংশ ধান নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যার আতঙ্ক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না কৃষক। চলতি ইরি-বোরো মওসুমে মোটা জাতের হাইব্রিড ধানের চেয়ে চিকন উফসি জাতের ধানের আবাদ বেশি হয়েছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় কৃষি বিভাগের কাছে পরিপূর্ণ এবং স্বচ্ছ কোন হিসাব নেই কোন জাতের ধান কত হেক্টরে আবাদ হয়েছে। কৃষি বিভাগ ও মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের সাথে আলোচনার ফলাফলে ব্যাপক তারতম্য ফুটে উঠেছে। আর এ কারণে কৃষি বিভাগের লক্ষমাত্রার সাথে প্রকৃত উৎপাদনের কোন মিল থাকে না শেষ পর্যায়ে। কৃষি বিভাগ গতানুগতিকভাবে প্রতি বছর এক রেখে অথবা সামান্য বাড়িয়ে আবাদ এর লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে। আর মাঠ পর্যায়ে কৃষক ধানের মূল্য প্রাপ্তির উপর নির্ভর করে আবাদ করে থাকে। হাইব্রিড ও চিকন জাতের ধান আবাদের উপর নির্ভর করে গড় মোট উৎপাদন।
পার্বতীপুর উপজেলার আমবাড়ী এলাকার কৃষক মোফাজ্জল হোসেন নিজের নয় বিঘা জমির মধ্যে হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করেছে মাত্র চার বিঘা জমিতে। বাকি জমিতে উফসি চিকন জাতের ধান আবাদ করেছে।
উফসি জাতের ধান ফলনে কম পেলেও দাম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু হাইব্রিড বিভিন্ন জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেলেও ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না। তার মতে মোটা ধান আবাদ করলে ফলন ভাল পাওয়া গেলেও ধানের দাম পাওয়া যায় না সময়মত। যদিও এবার মোটা ধানের দামও ভাল পাওয়া গেছে। কিন্তু ঝুঁকি কমাতে এবারও মিনিকেট, স্বম্পা কাঠারী, চিনিগুড়া আবাদ করেছে বেশি করে। ফলনও ভাল হয়েছে। সেচ নির্ভর হওয়ায় এবার দিনাজপুর অঞ্চলে বোরো ধান গাছ তুলনামুলকভাবে ভাল হয়েছে এবং শীষও ভাল এসেছে।
তবে নদী সংলগ্ন এলাকাগুলিতে কিছুটা আবাদ খারাপ হয়েছে এবং হিট স্ট্রোকের প্রভাবে গাছের পাতা ঝলসে গেছে। গত আমন মৌসুমে কাঠারী (চিকন) ধানের শীষ দেখে বুক ভরে উঠেছিল এই কৃষকের। কিন্ত শেষ মুহুর্তে দেখা দেয়া অজ্ঞাত রোগ সব কেড়ে নেয়। এমনই রোগ যে পযখানে ধরে নিমিষেই সেখান থেকে একরের পর একর জমি নিঃশেষ হয়ে যায়। বিরল উপজেলায় অনেক এলাকায় ব্রাশ ফায়ার এর শিকার শত শত বিঘা জমির ধানই কাটেনি কৃষক। আক্রমনের ধারা দেখে গ্রাম পর্যায়ে এই রোগটিকে ব্রাশ ফায়ার বলে অভিহিত করছে।
বিরামপুরের শিক্ষিত-সুচিন্তিত এবং সফলচাষী হিসাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক মো. আবু তাহের তার মোট ৩০ বিঘা জমিতেই এবার চিকন জাতের নাজিরশাইল ধান আবাদ করেছে। ইরি-বোরো মওসুমে মোটা জাত বাদ দিয়ে চিকন জাতের ধান আবাদের কারন জানতে চাইলে তিনি জানান, চিকন জাতের ধানের ফলন কম হলেও এই আগে-ভাগেই কাটা-মাড়া যায় এবং ভাল দামও পাওয়া যায়। তার মতে অনাবৃষ্টি ইরি-বোরো’র যতটা ক্ষতি করতে পারে না তার চেয়ে বেশী ক্ষতি করে ধানের দানা বা শীষ আসার পর নেক ব্লালাসহ বিভিন্ন পোকার আক্রমণ।
দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ তোহিদুল ইসলাম জানান, এবার জেলায় এক লাখ ৭১ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান আবাদের লক্ষমাত্রা রয়েছে। উৎপাদন লক্ষমাত্রা রয়েছে প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন।
মাঠ পর্যায়ের তথ্যে জানা গেছে, দিনাজপুরের পূর্বাংশে অর্থাৎ ঘোড়াঘাট, বিরামপুর, হাকিমপুর উপজেলায় আর কয়েকদিনের মধ্যে ধান কাটা মাড়া শুরু হবে। পশ্চিমাংশের সদর বিরল, বোচাগঞ্জসহ ঠাকুরগাঁও জেলায় আরো একটু দেরিতে ধান কাটা মারা শুরু হবে। শেষ মুহুর্তে রোগ বালাই না দেখা দিলে কৃষক এবার হাসবে। তবে যেভাবে তাপদাহ চলছে তাতে যে কোন মুহুর্তে রোগ বালাই তথা ব্রাশ ফায়ারের মত রোগ দেখা দেয়ার দুশ্চিন্তায় রয়েছে কৃষক ও কৃষি বিভাগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন