আমাদের সংবিধানে নিরাপদ ও যথাযথ পণ্য ও সেবা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অথচ, প্রতিনিয়ত সেই মৌলিক অধিকার লংঘিত হচ্ছে। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণের জন্য সর্বশেষ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। তবে ভোক্তা অধিকার বলতে অনেকে দ্রব্য ও খাদ্য ভেজালকে বুঝে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত অধিকার ও সেবাগুলোকে ভোক্তা অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে জাতিসংঘ। সে হিসেবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার পাশাপাশি নিরাপদ তথ্য আদান প্রদান, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মোবাইলে আর্থিক লেনদেন, জীবিকা নির্বাহ, নিরাপদ যাতায়াত, মুক্ত মত প্রকাশ, নির্মল পরিবেশ সবকিছুই ভোক্তা অধিকারের আওতাভুক্ত।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে যে সমস্ত বিষয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলো: পণ্যের মোড়ক ইত্যাদি ব্যবহার না করা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, সেবা মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা, ভেজাল পণ্য ও ওষুধ বিক্রি করা, নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ করা, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাকে প্রতারণা করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা, ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করা, নকল পণ্য উৎপাদন করা, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা প্রস্তাব করা, অবহেলা ইত্যাদির মাধ্যমে সেবা গ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য জীবনহানি ইত্যাদি ঘটানো এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা ইত্যাদি। যে কোনো ব্যক্তি অপরাধগুলোর যে কোনো একটা সংঘটিত করলে এবং এই আইনের অধীনে দোষী প্রমাণিত হলে অনধিক পঞ্চাশ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদন্ড এবং এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার সুযোগ ভোক্তার আছে। কিন্তু ভোক্তা স্বার্থ লঙ্ঘিত হওয়া, জনগণ প্রতারিত হওয়া, জনভোগান্তি লাঘব ও আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রেখে আমাদের বর্তমান আইনটি সংশোধন করা ও যুগোযোগী করা একান্ত প্রয়োজন।
এই আইনের সীমাবদ্ধতা হলো: (১) এই আইনের ২ নং ধারায় সংজ্ঞার আওতায় যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তাতে কিছু কিছু সংজ্ঞা পরিষ্কারভাবে ও বিস্তৃত আকারে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘খাদ্যপণ্য’-এর সংজ্ঞা। এক্ষেত্রে পিওর ফুড অর্ডিনেন্স ১৯৫৯-এর আওতায় ফুড-এর সংজ্ঞা অধিক গ্রহণযোগ্য। আবার ভোক্তারা অনেকভাবে ‘মিথ্যা বিজ্ঞাপনে’র মাধ্যমে প্রতারিত হলেও আইনে ‘মিথ্যা বিজ্ঞাপন’ (misleading advertisement) এর সংজ্ঞা উল্লেখ করা হয়নি। (২) এই আইনে অন্যায্য চুক্তি (misleading advertisement) বা একপক্ষীয় চুক্তি(one sided contract) বিষয়ে ভোক্তাদের সুরক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে উল্লেখ নেই। (৩) এই আইনের প্রথম অধ্যায়ের ২২ নং ধারায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, ফাইন্যান্সিং, ইন্সুরেন্স, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্যান্য আর্থিক ‘সেবা’ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এছাড়া বোডিং, লজিং, বাসা/স্থান ভাড়া, ইন্টারনেট, ডিস লাইন, বাসা-বাড়ি ব্যবহার্য ইলেক্ট্রনিক ও বৈদ্যুতিক আইটেম, ই-কমার্স, প্রশিক্ষণ/টিউশন/কোচিং, ডাক ও কুরিয়ার সার্ভিস অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব একজন নাগরিককে ভোক্তা অধিকার লাভে প্রতিনিয়তই ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার করছে। (৪) এই আইনের ধারা ৬২(৩) ও ৭৬(৬) অনুযায়ী যিনি অভিযোগকারী তাকে নিজেকেই গবেষণাগারে নকল বা ভেজাল নমুনা পরীক্ষার জন্য (অভিযোগকারীকেই) নির্ধারিত অর্থ বা ফি জমা দিতে হবে। এটি অভিযোগকারীর অভিযোগ দায়ের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। (৫) এই আইনের অধীন ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কোনো কাজের কারণ উদ্ভব হবার ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে মহাপরিচালক কিংবা অধিদফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ দায়ের করতে হবে যা বাস্তবক্ষেত্রে অনেক সময় সম্ভব না হওয়ায় ভোক্তাদের অভিযোগ দায়েরের সুযোগ থাকে না। এইরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনে প্রতিবেশী ভারতে ১ বছর ও মালয়েশিয়ায় ৩ বছর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। (৬) এই আইনের ৬০ নং ধারা অনুযায়ী কোনো অভিযোগকারী সরাসরি আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে না। অভিযোগকারীকে মহাপরিচালক কিংবা অধিদফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ দায়ের করতে হয়, যা অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে একটি প্রধান বাধা। (৭) আইনের ৭১ নং ধারা অনুযায়ী, ভোক্তা অধিকার কার্যবিরোধী কাজের অভিযোগে অভিযোগকারী প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কোনো মামলা সরাসরি করা যায় না। পৃথিবীর সবদেশে ভোক্তা আইনের পৃথক আদালত ব্যবস্থা আছে। (৮) এই আইনের ৬১ নং ধারা অনুযায়ী, অভিযোগ দায়ের হবার ৯০ দিনের মধ্যে মামলা দায়েরের জন্য অভিযোগপত্র দাখিল না করা হলে, ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারার্থ আমলে গ্রহণ করবেন না। এর ফলে ভোক্তা অধিকার রক্ষা হবে না। (৯) এই আইনের ৬১ নং ধারা অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারার্থ আমলে গ্রহণ না করলে তার কারণ জানানোর বা তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে অভিযোগকারীকে জানানোর বাধ্যতামূলক কোনো ব্যবস্থা নেই। (১০) এই আইনের ৭৩ নং অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে পরিচালিত স্বাস্থ্য পরিষেবায় পরিলক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতি বিষয়ে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা অধিদফতরের মহাপরিচালক গ্রহণ করতে পারেন না যার ফলে স্বাস্থ্য খাতে পরিলক্ষিত ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। (১১) এই আইনের অধীনে ছোটখাটো অভিযোগ অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতির অভিযোগ স্থানীয়ভাবে বিকল্প অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা (Alternative Dispute Resolution Mechanism) রাখা হয়নি। অথচ এতে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র বা নিরক্ষর ভোক্তাদের বিচার পাবার অধিকার অধিকতর সুরক্ষিত হয়। পৌর, উপজেলা, ইউপি চেয়ারম্যান, ক্যাব প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি সমন্বয়ে সালিশি কমিটির মাধ্যমে মীমাংসা করা যেতে পারে। ব্রাজিল, মালয়শিয়া প্রভৃতি দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে অউজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি আই ফোন ১১ এর চার্জার সরবরাহ না করায় ব্রাজিলের কনজুমার প্রটেকশেন এজেন্সী বিশ্বখ্যাত অ্যাপলকে ২০ লাখ ডলার জরিমানা করেছে। (১২) এই আইনের ৭৮ নং ধারা অনুযায়ী, বিক্রেতা কোনো ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজের সঙ্গে জ্ঞাতসারে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে যে দায় হতে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তার মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দায়ী ব্যক্তিও এই ধারার কারণে আইনের আওতায় নেয়া অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নাও হতে পারে। (১৩) কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের শাস্তির মেয়াদ ও অর্থদন্ডের পরিমাণ বাড়ানো উচিত যেমন জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল, খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল ইত্যাদি। (১৪) জনগণ যাতে সহজে অভিযোগগুলো জানাতে পারে সেজন্য জেলা পর্যায়ে নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের আদলে ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়ন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা জরুরি, যেখানে সহজে বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করা যাবে। জেলা পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, ব্যবসায়ী ও ক্যাব প্রতিনিধি সমন্বয়ে বিচারিক পরিষদ গঠন করা যায়। (১৫) জাতীয় ভোক্তা কাউন্সিলে ভোক্তাদের প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানো। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ভোক্তা প্রতিনিধি হিসাবে ক্যাব এর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। (১৬) মজুত আইনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা, স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট এ ২১ দিন কিভাবে গণনা করা হবে তা পরিষ্কার করা। (১৭) স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অভিযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের বিধানটি বাতিল করে তার নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। (১৮) ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে ভোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাব-এর অন্তর্ভুক্ত করার বিধানটি কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করা। (১৯) বাজার অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানার একটি অংশ। ক্যাব এর মাধ্যমে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক ভোক্তা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার উদ্যোগ নেয়া। (২০) বাজারদর ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, ভোক্তা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক, জেলা মার্কেটিং অফিসার, ক্যাব প্রতিনিধি, শিল্প বণিক সমিতির প্রতিনিধি ও সাংবাদিক প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি বাজার মনিটরিং কমিটি গঠন করা এবং নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা। (২১) প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ভোক্তাদের আদান প্রদান অটোমেশন পদ্ধতিতে ডাটাবেইজ অনলাইন সার্ভিস হওয়াটা জরুরি প্রয়োজন।
বাজার থেকে পণ্য বা কোন সেবা কিনে যেন কোন ক্রেতা প্রতারণার শিকার না হয় এমনকি নিজের অজান্তেও ভোক্তা যেন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে না পড়েন সেজন্য কয়েক বছর ধরেই বাজার তদারকিতে তৎপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এসব বাজার অভিযানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের যেমন সচেতন করা হয়, তেমনি ক্রেতার স্বার্থ বিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হলে জরিমানাও আদায় করা হয়।
জনগণের বহুল প্রত্যাশিত এই আইনটি প্রচলিত আইনের সফল প্রয়োগ ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংশোধন করে যুগোপযোগী করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে এবং বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার এ বিষয়ে আশু কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসবে, এ প্রত্যাশা করি।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন