গাজীপুরে টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীতে একটি প্যাকেজিং কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিকা- ও ভবন ধসে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশত। শনিবার সকালে বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পরেই ধসে পড়ে ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের সাততলা ভবনের তিন দিক থেকে ঘেরা চারতলার অংশ। ভবনের ভেতরে আটকে থাকা কারখানার আরো অর্ধশতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন উদ্ধারকর্মীরা। বেশ কয়েকটি পোড়া লাশ ভবনের ভেতরে পড়ে থাকতে দেখেছেন উদ্ধারকর্মীরা। দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের প্রতি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বয়লার বিস্ফোরণে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। অপর এক শোকবাণীতে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন এবং আহতদের সুচিকিৎসা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীও পৃথক পৃথক বাণীতে শোক প্রকাশ করেছেন। বয়লার বিস্ফোরণে আগুনের ঘটনায় গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রায়হানুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিমকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। ঘটনার কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল মুশাররফ হোসেন মনে করেন বয়লার বিস্ফোরণ থেকেই আগুনের উৎপত্তি। অন্যদিকে বয়লারের প্রধান পরিদর্শক এমএ মান্নান মনে করেন বয়লার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়নি।
বাংলাদেশে বয়লার বা এধরনের বিস্ফোরণ এই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন কারখানায় এধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসবে প্রাণহানির ঘটনাও কম ঘটেনি। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়েছে সেকথা বলা যাবে না। মাত্র ক’দিন আগে চট্টগ্রামের একটি সার কারখানায় অ্যামনোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে সেখানে পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছিল। এর রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই ঘটেছে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা। ইতোমধ্যেই দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে একধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষীয় ভাষ্যের সাথে মিলিয়ে বয়লার পরিদর্শকও বলছেন আগুনের উৎস বয়লার নয়। অন্যদিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, বয়লারটি ছিল ৩৬ বছরের পুরনো। এটি প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে চালানো হয়নি। পানির লেভেল ও স্টিম প্রেসার ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ৫ বারেরও বেশি বয়লারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ও ফিটিংস ব্যবহার করা হয়েছে। কারখানাটির মালিক একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, বয়লারটির মেয়াদ এখনো আছে। এটি যথাযথভাবে মেরামত করে চালানো হচ্ছিল। সবকিছুই বয়লার পরিদর্শক কার্যালয়কে অবহিত করা হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, প্রাথমিক তদন্তে বয়লারটি অক্ষত ছিল। তিনি মনে করেন, গ্যাসের চাপের কারণেই মূলত এ দুর্ঘটনা ঘটছে। এদিকে ফায়ার সার্ভিসের ইনসিডেন্ট কমান্ডার মনে করেন, বয়লার বিস্ফোরণের কারণেই এধরনের ঘটনা ঘটেছে। অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিয়মানুযায়ী একটি বয়লারের মেয়াদ ২০ বছর। আলোচ্য বয়লারটির বয়স ৩৬ বছর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাধিক কারণে এধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বয়লারে পানির লেভেল কমে যাওয়া এবং গ্যাসফায়ারিং অব্যাহত থাকা। এতে বয়লারের মধ্যে থাকা সবপানি স্টিম হয়ে প্রেসার বেড়ে গিয়ে বয়লারটি বিস্ফোরিত হতে পারে। ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্রউদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন, ঘটনার কিছু সময় আগে বয়লারে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাসসংযোগ বন্ধ করা হয়নি। বলা হচ্ছে, ওই কারখানায় দুটি বয়লার ছিল। বিস্ফোরণের পর ধ্বংস হওয়া বয়লারটি দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আর যেটি অক্ষত ছিল সেটি তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের দেখানো হয়েছে। তিতাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, বয়লারে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহারের অনুমতি ছিল কারখানা কর্তৃপক্ষ গোপনে অবৈধভাবে অতিরিক্ত লোড নিয়ে বয়লারটি চালাতো। বাস্তবতা হচ্ছেÑ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপজ্জনকভাবে ব্যবহারের কারণে প্রায়ই বয়লার দুর্ঘটনা ঘটলেও পরিদর্শনের মান উন্নত হচ্ছে না। দেশে সচল প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বয়লার রয়েছে। জনবল সংকটে ঠিকমত পরিদর্শন করা হয় না। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এটা নিসন্দেহে বলা যায়, গোটা বিষয়টিতে নানা ধরনের অবেধ অর্থের খেলা থাকতে পারে। বয়লার নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যা বলেছেন তার সত্যতা কতটা তা সঠিক সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া প্রমাণিত হবার সুযোগ নেই। গ্যাস চাপের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটিও গভীরভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ কিভাবে অবৈধভাবে লোডবৃদ্ধি করা হয়েছে বা কারা এরসাথে জড়িত তা খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে উঠেছে।
ঈদের ছুটিতে সবাই যখন স্বজনের সাথে সাক্ষাতে বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন এই ঘটনা সত্যিই মর্মান্তিক। কার্যত ঈদের আনন্দকেই মøান করে দিয়েছে। আলোচ্য দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব মর্মস্পর্শী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রতিটি সহানুভূতিশীল মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবার কথা। আমরাও গভীরভাবে মর্মাহত। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। যারা নিহত হয়েছেন, তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। যারা আহত হয়েছেন দ্রুতই যাতে তারা আরোগ্যলাভ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে সেজন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী নিহতদের পরিবার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন এবং আহতরা প্রয়োজনীয় সুচিকিৎসা পাবেন, এটাই প্রত্যাশিত। একথা অবশ্যই জোর দিয়ে আমরা বলতে চাই এধরনের ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে এর গুরুত্ব খাটো করার কোন অর্থ হয় না। এ ঘটনা কতটা মানব সৃষ্ট সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। সবমিলে আমরা মনে করি এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষিদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। সংশ্লিষ্ট সকলে এব্যাপারে আন্তরিক হবেন- এটাই প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন