সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

রোজা রাখুন সুস্থ থাকুন

| প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৩ এএম

সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্থ পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, কামাচার, লোভ, লালসা, অশ্লিলতাসহ দুনিয়াবি অন্যায় অপরাধ থেকে মুক্ত থেকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিজেকে উৎসর্গ করার নাম রোজা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “রোজা আমার জন্য, আমি নিজে রোজার প্রতিদান দেব।” আমরা সকল ইবাদতই আল্লাহর জন্যই করি। তাহলে রোজাকে আল্লাহ কেন বললেন ‘আমার জন্য।’ আসলে অন্য সব ইবাদত করার পাশাপাশি তা প্রদর্শনের সুযোগ ও মনোভাব থাকে, যেমন নামাজ, হজ, যাকাত ইত্যাদি। কিন্তু রোজা আল্লাহ এবং বান্দা ছাড়া প্রদর্শনের বা জাহির করার কোন সুযোগই থাকে না। আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যই আমাদের জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণের মূল নিয়ামক। এই আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো রোজা। দিনে রকমারি খাবারের প্রাচুর্য্য থাকার পরও বান্দা তা মুখে তোলে না। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে গেলেও পানি পান থেকে বিরত থাকে। প্রিয়জনদের সঙ্গে ইফতার সাজিয়ে বসে থাকে, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পূর্বে মুখে নেয়া হয় না। এদের উদ্দেশ্যে হাদিসে বলা আছে- “যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) আনুগত্য করে, সে-ই সফলকাম”। বান্দা যেহেতু শুধু আল্লাহর হুকুম পালন এবং সন্তুষ্টির জন্য রোজা রাখে, তাই আল্লাহতায়ালা নিজ হাতেই তার পুরস্কার দিবেন। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারের জন্য রয়েছে দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন, আত্মিক ও নৈতিক অবস্থার উন্নতিসহ অশেষ কল্যাণ ও উপকার লাভ করার সুযোগ। রোজা মানুষকে সংযমী ও শুদ্ধ করে এবং অশ্লীল-মন্দ থেকে বিরত রাখে।

আর সেজন্যই প্রত্যেক মুমিন মুসলমান, সুস্থ অথবা রোগাক্রান্ত, সবাই রোজা রাখতে চান এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান। তবে রমজানে রোগীরা প্রায়ই রোজা রাখবেন কি রাখবেন না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। অবশ্য কি কি অবস্থায় রোজা রাখা যাবে বা যাবে না তার সুস্পষ্ট বিধান শরীয়তে আছে।

রমজানে বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে ভুগছেন, তাদের সমস্যা হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও রোজা রাখতে তারা প্রবল আগ্রহী। তারা যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজার মাসের জন্য ওষুধ সেবনবিধি ঠিক করে নিতে পারেন, তবে সহজেই রোজা রাখতে পারেন। এতে রোজা ভাঙ্গার বা রোজা থেকে বিরত থাকার কোন প্রয়োজন হয় না।

রুগীর জন্য রোজা
রোজা রাখার উদ্দেশ্য শরীরকে দুর্বল করে অকর্মন্য করা নয়, বরং শরীরকে সামান্য কিছু কষ্ট দিয়ে দৈহিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধন। শুধু তাই নয়, অনেক রোগের বেলায় রোজায় ক্ষতি না হয়ে বরং বহু রোগব্যাধির প্রতিরোধক এবং আরোগ্যমূলক চিকিৎসা লাভে সহায়ক হয়। রোজায় স্বাস্থ্যের সমস্যার চেয়ে বরং স্বাস্থ্যের উপকারই বেশি হয়।

ডায়াবেটিস রোগী
রোজা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ ও রহমতস্বরূপ। ডায়াবেটিস রোগীরা সঠিক নিয়মে রোজা রাখলে নানা রকম উপকার পেতে পারেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল উপায় হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, আর রোজা রাখা হতে পারে এক অন্যতম উপায়। এতে সহজেই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও সুন্দরভাবে করা যায়। যারা ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল নন, তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখা হতে পারে আদর্শ চিকিৎসা ব্যবস্থা। যারা ইনসুলিন নেন তাদের ক্ষেত্রেও রোজা অবস্থায় ওষুধের মাত্রা কমাতে সহায়ক। শুধু রক্তের গ্লুকোজই নয়, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণেও রোজা মোক্ষম। এর সঙ্গে সঙ্গে রোজা ডায়াবেটিস রোগীকে সংযম, পরিমিতিবোধ ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয় যা ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় অপরিহার্য।

রক্তের কোলেস্টেরল
যাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, রোজা তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। রোজা ভাল কোলেস্টেরলকে (এইচডিএল) বাড়াতে এবং মন্দ কোলেস্টেরলকে (এলডিএল) ও ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে।

অতিরিক্ত ওজন
যাদের ওজন অতিরিক্ত, তাদের ক্ষেত্রে রোজা ওজন কমানোর জন্য এক সহজ ও সুবর্ণ সুযোগ। ওজন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন রোগ থেকে বেঁচে থাকা যায় যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, বাতের ব্যাথা, অস্টিও আরথ্রাইটিস, গাউট ইত্যাদি। আবার ওজন কমাতে পারলে কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে আসে।
হৃদরোগী এবং উচ্চ রক্তচাপ
রোজার মাধ্যমে ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ হওয়ার ফলে যারা হৃদরোগে অথবা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন তাদের জন্য রোজা অত্যন্ত উপকারী। এতে শরীরের, বিশেষ করে রক্তনালীর চর্বি হ্রাস পায়, রক্তনালীর এথেরোস্কে¬রোসিস কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

পেপটিক আলসার
একসময় ধারণা ছিল পেপটিক আলসারে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন না, তাদের ঘন ঘন খাওয়া খেতে হবে, অনেকক্ষণ পেট খালি রাখা যাবে না। অনেকে মনে করেন রোজা পেপটিক আলসারের ক্ষতি করে এবং এসিডের মাত্রা বাড়ায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব ধারণা ঠিক নয়। রোজায় নিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়ার ফলে এসিডের মাত্রা কমে যায়। তাই সঠিকভাবে রোজা রাখলে এবং সঠিক খাবার দিয়ে সেহেরি ও ইফতার করলে রোজা বরং আলসারের উপশম করে, অনেক সময় আলসার ভাল হয়ে যায়। এছাড়া রোজা গ্যাস্ট্রাইটিস, আইবিএস ইত্যাদি রোগেও উপকারী।

শ্বাসকষ্ট বা এজমা রোগী
যারা এই সমস্ত রোগে ভোগেন, তাদেরও রোজা রাখতে কোন অসুবিধা নেই। রোজায় এ ধরনের রোগ সাধারণত বৃদ্ধি পায় না। বরং চিন্তামুক্ত থাকায় এবং আল্লাহর প্রতি সরাসরি আত্মসমর্পণের ফলে এ রোগের প্রকোপ কমই থাকে। প্রয়োজনে রাতে একবার বা দু’বার ওষুধ খেয়ে নেবেন যা দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখে। দিনের বেলায় প্রয়োজন পড়লে ইনহেলার জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যায়, যা রোজার কোন ক্ষতি করবে না।

রোজা রাখা নিয়ে রোগাক্রান্তদের মধ্যে অনেক রকম দ্বিধা রয়েছে।
কিছু কিছু রোগ আছে যার জন্য সব সময় চিকিৎসা নিতে হয়। কিংবা নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। সে সব ক্ষেত্রে অনেকেই রোজা রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্রনিক বা দীর্ঘ মেয়াদী রোগই দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকর ওষুধ গ্রহণ করে রোজা রাখা সম্ভব। এসব ওষুধের কোনটি দেনে ১ বার, আবার কোনটি দিনে ২ বার খেলেই যথেষ্ট। কাজেই রোজা রেখেও রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব কিংবা চিকিৎসা চলা অবস্থায়ও রোজা রাখা যায়।

তবে সব ক্ষেত্রেই তা সম্ভব নয়। কোন রোগে তীব্রভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকলে রোজা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এবিএম আবদুল্লাহ কিছু রোগের কথা উল্লেখ করেছেন, যেসব ক্ষেত্রে রোজা রাখা সম্ভব হতে পারে-পেপটিক আলসারের রোগীদের মধ্যে অধিকাংশই রোজা রাখলে ভালো বোধ করেন। কারো কারো ক্ষেত্রে রোজা রাখলে সমস্যাটা বেড়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখাটা অনুশীলনের ওপর নির্ভর করে। রোজা রাখতে চেষ্টা করে অসুবিধা দেখা না দিলে রোজা রাখা যাবে। পেপটিক আলসার বা এ জাতীয় স্বাস্থ্য সমস্যায় ব্যবহৃত ওষুধ সাধারণত দৈনিক ২ বারের বেশি খেতে হয় না। কাজেই রোজা রাখতে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়।

যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মুখে ওষুধ গ্রহণ করছেন কিংবা খাদ্য তালিকা মেনে চলছেন তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখা ভালো-বিশেষ করে ওজন কমানোর দিক থেকে। তবে হাইপো গ্লাইসেমিয়া হয়ে যায় কিনা সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। তবে যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

রোগের দোহাই দিয়ে অযথা নিজ সিদ্ধান্তে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকার কোন মানে হয় না। তার আগে একবার জেনে নিন আপনার চিকিৎসক এ সম্পর্কে কি বলেন।

বাংলাদেশে সেহরি ও ইফতারের অধিকাংশ খাবারই হচ্ছে তেলেভাজা। যা ঠিক পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তাছাড়া সেহরি ও ইফতারের খাবার নির্বাচনে রোজাদারের বয়স ও শারীরিক অবস্থাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। সেহরিতে ভাত থাকবে, ভাত নির্ভেজাল খাবার, ভাতের সঙ্গে হাই প্রোটিনযুক্ত খাবার রাখা উচিত।

হাইপ্রোটিনযুক্ত খাবারের তালিকায় রয়েছে-গোস্ত, ডিম, মাছ ইত্যাদি। তবে যাদের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারা গরু, খাসির পরিবর্তে মুরগি, মাছ কিংবা কুসুম ছাড়া ডিম খেতে পারেন। ডালকে বলা হয় গরিবের প্রোটিন। ডাল উদ্ভিদ প্রোটিন বলে এর সঙ্গে ক্ষতিকর চর্বি নেই।

সেহরিতে যেকোন একটি সবজি রাখা উচিত। সবজিকে সংযোজন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করা। সেহরিতে দুধ-কলা অনেকের পছন্দ। দুধ কলা মসলাহীন বলে পাকস্থলীতে উত্তেজনা সৃষ্টির ঝুঁকি কম থাকে।
যাদের পেটে অতিরিক্ত গ্যাস হয় তারা গ্যাস উদ্রেককারী খাবারগুলো এড়িয়ে চলবেন।

ইফতারে উত্তেজক খাবার বর্জন করতে হবে। ইফতার শুরু করতে হবে তাজা ফলের রস কিংবা লেবুর রসের শরবত দিয়ে। বাজারের রঙ্গিন শরবতে বর্জন করা উচিত। কারণ রঙ্গিন শরবতে ব্যবহৃত হয় কৃত্রিম রং যা ক্যন্সারের উদ্রেককারী বলে স্বীকৃত। যে কোন তাজা ফলের শরবত শরীরকে তাজা রাখবে শরীরে মিনারেলের ঘাটতি পূরণ করবে। শরবতের পর রাখা যেতে পারে যে কোন মৌসুমী ফল। ফল সহজপাচ্য ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে পূরণ করে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের ঘাটতি। যা শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ইফতারির প্রচলিত মেন্যুর মধ্যে বুট, ছোলা ও মুড়ি স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর কিন্তু তেলেভাজা পিঁয়াজু ও বেগুনি জাতীয় খাবার গ্যাসের উদ্রেক করে বদহজমের সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এসব খাবার পুরনো তেলে ভাজা হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। ইফতারে প্রচুর পানি পান করতে হবে। খেতে হবে কম মসলাযুক্ত খাবার। ইফতারে মিষ্টি জাতীয় খাবার রাখাও মন্দ নয়, যদি তা খেতে চিকিৎসকের নিষেধ না থাকে। তবে বেশি খাওয়া যাবে না। ইফতারে খেজুর-খুরমা রাখাও ভালো। খুরমা খুব দ্রুত শরীরের গ্লুকোজ ঘাটতি মেটাতে পারে ও শরেিরর দুর্বলতা দূর করে।

উপসংহারে বলা যায়, রোজা যেহেতু আল্লাহ তায়ালার জন্য এবং আল্লাহ এর পুরস্কার দেবেন, তাই কেউ যদি মনে করেন আমি আল্লাহর জন্যই রোজা রাখব, যা হবার হবে, তার কোন সমস্যাই হবে না। আর যারা মনে করবে রোজা রাখলে নানা রকমের সমস্যা হবে, রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে, নানা রকম জটিলতা হবে, তাদের বেলায় এসব সমস্যা হবার সম্ভাবনাই বেশি। দৈহিক রোজার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের রোজাটাই আসল, তাই কোন অজুহাত বা আলস্য করে রোজা পালন থেকে বিরত থাকা উচিত নয়।

আলম শামস
কবি ও সাংবাদিক
E-mail : alamshams1979@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন