রেজাউল করিম রাজু : ত্যাগের মহিমা আর অনাবিল আনন্দের মধ্য দিয়ে ঈদ উৎসবে মেতে উঠেছিল রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। যদিও এই রোদ এই মেঘ বৃষ্টি তাতে খানিকটা হলেও ছন্দপতন ঘটিয়েছে। সকালের দিকটা মেঘলা থাকায় মানুষ ঈদগাহ ময়দানে আর বড় বড় রাস্তায় অনুষ্ঠিত জামাতে বেশ স্বস্তির সাথে নামাজ আদায় করেছে। বিপত্তি বাধে কোরবানি করতে গিয়ে। কারো কোরবানি পশু জবেহ হয়েছে আবার কারো প্রস্ততি চলছে। এর মধ্যে আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি। চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন কোরবানিদাতারা। কি রাস্তা কি খোলা মাঠ আর বাড়ির উঠোন কিংবা সামনের আঙিনা সর্বত্র ভিজে একাকার। বৃষ্টিরও রকমফের ছিল। কোথাও হয়েছে ভারী আবার কোথাও হাল্কা ধরনের। আবার বৃষ্টি থামলেও ছিল ভাদ্রের তালপাকা গরম। এমন পরিবেশের মধ্য দিয়ে চলে কোরবানির কর্মকাÐ। অনেকের সবকিছু শেষ করতে বিকেল গড়িয়ে যায়। কোরবানির মাংস সংগ্রহকারী হত-দরিদ্ররা এবাড়ি-ওবাড়ি এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় ছুটে যায়। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি মাংস পাঠানো হয় চিরচরিত নিয়মে। কোরবানির মাংস নিয়ে ধনী গরিব সবার মধ্যে উৎসাহের কমতি ছিল না। কি শহর কি গ্রাম সর্বত্র একই দৃশ্য। সন্ধ্যায় নগরীর বাস টার্মিনাল ও স্টেশন এলাকায় বসে কোরবানির মাংসের বাজার। বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা মাংসের খানিকটা খাবার জন্য রেখে বাকীটা নিয়ে আসে বিক্রির জন্য, যা পায় তা দিয়ে চাল ডাল তেল মসল্লা কিনে রাতের বেলা মেতে ওঠে ঈদ খাবার উৎসবে। কোরবানির মাংসের বাজারের ক্রেতা হলো নি¤œবিত্ত মানুষ। যাদের কোরবানি দেবার সামর্থ্য নেই। এখানে কম দামে পাওয়া যায় বলে সাধ্যমত ক্রয় করে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য। তবে এ বাজারেও বাগড়া দিয়েছে মাঝারী ও ফুটপাতের খাবার হোটেলগুলো। তারা কম দামে এসব কিনে নেয় ব্যবসার জন্য। এখানেও রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী। দাড়িপাল্লা নিয়ে বসে শুধু ওজন করে দেবার জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে আদায় করে দশ বিশ টাকা। মাংসের পরিমাণের সাথে এদের রেটও বাড়ে। অনেক মধ্যবিত্ত মানুষও আসেন এসব মাংস ক্রয় করতে। এমনি একজন মহিম তপন বলেন, এখানকার মাংসের স্বাদই আলাদা। কারণ নানা ধরনের গরুর মাংসের মিশ্রণ থাকে। তাই স্বাদও ভিন্ন হয়। সেই স্বাদের জন্য প্রতিবছর দু’পাঁচ কেজি মাংস ক্রয় করেন। এবার চামড়ার দাম ছিল সবচেয়ে কম। স্বল্প দামে চামড়া বিক্রির কারণে কোরবানিদাতা আর হত-দরিদ্র মানুষ এবং এতিমখানাগুলোর মন ভালো ছিল না। অনেকেই আছেন চামড়ার টাকা সংগ্রহ করে কেউ চিকিৎসা করান। কেউ জরুরি প্রয়োজনে লাগান। এতিমখানা লিল্লাহ বেডিংগুলোরও একটা আয় হয়, যা দিয়ে বছরের কটাদিন ভালো যায়। ঈদের দিনটা বৃষ্টি বিঘিœত হলেও পরদিন ছিল একেবারে ঝলমলে। আগের দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে বেরিয়ে পড়া। চলে স্বজনদের বাড়ি যাওয়া-আসা।
শিক্ষা নগরী হিসাবে খ্যাত রাজশাহীতে পড়াশোনা করতে আসে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। আবার বিভাগীয় নগরী হবার কারণে চাকরির সুবাদেও আসেন অনেকে। তাদের পদচারনায় মুখরিত থাকে নগরী। তারা নাড়ির টানে ফিরেছেন নিজ নিজ শহর আর গ্রামে। ফলে নগরীতে বেশ কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা ভাব। সব ক্যাম্পাস বন্ধ। ছাত্রবাস মেস বাড়িগুলো খা খা করছে। বাজার হাটও বন্ধ। এমন অবস্থার মধ্যেও ভিড়ের কমতি নেই নগরীর বিনোদন স্পটগুলোয়। সকাল থেকে শহরতলী ও গ্রাম থেকে বিভিন্ন যানবাহনে ছুটে আসে এসব স্থানে বিনোদন পিয়াসী মানুষ। সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত প্রচÐ ভিড় দেখা যায় এসব স্থানে। বিশেষ করে পদ্মার তীরে। ওপারের বন্যার চাপ কমাতে মরণবাঁধ ফারাক্কার শতাধিক গেট খুলে দেয়ায় বান ডেকেছিল মরা গাঙ্গে। ছুটে চলছিল ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। নগরবাসীও শঙ্কিত ছিল। ওপারে বন্যার চাপ কমায় ফারাক্কার গেটগুলো ফের বন্ধ করে দেয়ায় পানির চাপ কমেছে। তবে ধার কমলেও ভার কমেনি। সেই পদ্মায় ভেসে বেড়িয়েছে রূপ দেখার জন্য বিভিন্ন যান্ত্রিক নৌযানে ভেসে বেড়িয়েছে নানা বয়েসী হাজারো মানুষ। বড়কুঠি ঘাটে এ নিয়ে প্রতিযোগিতার কমতি ছিল না। ভালোই আয় হয়েছে মাঝিদের। হালিম, চটপটি, ফুচকা, চা-কফি, বাদাম, পেয়ারার বিক্রতেরা ছিল ভীষণ ব্যস্ত। এখানকার আড্ডার একটা খ্যাতি রয়েছে। এবারও তার কমতি ছিল না। কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও যারা ফিরে এসেছেন তারা মেতে উঠেছেন নিজ নিজ বলয়ের আড্ডাস্থলগুলোয়। সেখানে একে অপরের খোঁজখবর নেয়া আর চলে খুনসুটি। বরাবরের মতো এবারও ঈদের পরদিন বসেছিল ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা। তারা মেতে উঠেছিল স্মৃতিচারণে। বাহাত্তর ব্যাচের শিক্ষার্থীরা জম্পেস আড্ডা জমিয়েছিল স্কুলের পাশেই প্রাক্তন ছাত্র ড. রুমির বাসভবনের ছাদে। প্রাক্তন কৃর্তী ছাত্ররা অংশ নিয়েছিল তাতে। ঈদের পরদিন থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কমিউনিটি সেন্টারগুলো। সব বুক হয়ে গেছে। ধুম পড়েছে বিয়েসাদির। এ সময় সবাইকে একসাথে পেয়ে বিয়েসাদির কাজটাও সেরে ফেলা হচ্ছে। ফুলগুলোর দোকানের সামনে বরের গাড়ি সাজানোর ভিড় নজর এড়ায় না। গতকাল ব্যাংক অফিস খুললেও তা ছিল ফাঁকা ফাঁকা। যারা এসেছিল তারাও কোলাকুলি ও আড্ডা দিয়ে সময় পার করে। আলোচনায় ছিল কোরবানির পশুর দাম আর মাংসের পরিমাণ নিয়েও। সব মিলিয়ে ঈদ শেষ হলেও এখনো এর রেশ কাটেনি, যা চলবে আরো ক’দিন ধরে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন