প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবী আক্রান্ত। চীনের উহান থেকে এর উৎপত্তি হলেও পুরো বিশ্বের তান্ডব চালাচ্ছে। এক সময় যারা নিজেদেরকে সুপার পাওয়া বলে জানান দিতো তারাও আজ এই ভাইরাসের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। সেখানে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে মানুষের জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা যেমন বিঘিœত হচ্ছে, তেমনি অর্থনীতির প্রায় প্রত্যেকটি খাত বিপর্যস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের এক শ্রেণির মানুষ যতটা উদ্বিগ্ন করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু নিয়ে, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন জীবন ও জীবিকা নিয়ে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ জীবিকা নিয়ে পড়েছেন মহাদুঃশ্চিন্তায়। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে এসব পরিবারের বোবা কান্না হাওয়ায় ভাসছে। নানা উছিলায় ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। যে যার মতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে পকেট ভারি করছে। অথচ পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং করা হচ্ছে না।
করোনার সংক্রমণ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় সরকার কর্তৃক ঘোষিত লকডাউন চলছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক নাকি ভুল, সে বির্তক অবান্তর। মানুষকে রক্ষা করার জন্যই সরকার লকাডাউন ঘোষণা করেছে। কিন্তু মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। লকডাউনের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদেরকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বাসার কাজে নিয়োজিত গৃহকর্মী, রিকশাচালক, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, ভ্যানচালক, হকার, কাঠমিস্ত্রি, দর্জি, নির্মাণ শ্রমিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে সহযোগিতা প্রদান করা প্রয়োজন। এসব পরিবারকে সহায়তা করার জন্যে সরকার একটি জরুরি সেবা নম্বর চালু করতে পারে। যেখানে মানুষ এসএমএস কিংবা ফোন করে তার সমস্যার কথা জানাতে পারেন। সরকার সেটা যাচাই বাছাই করে সহযোগিতা করবে। কেউ ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিলে শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এই কাজটি সরকার করতে পারে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে করোনার প্রভাবে দেশে নতুন করে প্রায় দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে এবং দেশের মোট শ্রমশক্তির ৩ শতাংশের বেশি মানুষ চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ২০১৮ সালে এটি ২১.৬ শতাংশ ছিল। ২০১৮ সালে শহরাঞ্চলে এ হার ১৬.৩ শতাংশ ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে তা বেড়ে ৩৫.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে গ্রামে দারিদ্র্যের হার ১১.২ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালে বেড়ে ৩৩.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে চিকিৎসাব্যয় ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে গড় মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মধ্যবিত্তের ৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অতিদরিদ্রদের ক্ষেত্রে তা ১০৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা উদ্বেগজন।
একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে না তখন সেখানে নানা অশান্তি দেখা দেয়। রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতা লেগেই থাকে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে উঠেনি। সর্বত্র লুটপাঠ আর দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যারা গরীবের ৫ কেজি চালের লোভ সামলাতে পারে না, তাদের রাজনীতি ছেড়ে ভিক্ষা করা উচিত। চোখের সামনে দেশ যখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশ তখনও রাষ্ট্রের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের করুণ কাহিনী পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে! নিম্ন বিত্তরা কোনোভাবে সামাল দিতে পারলেও মধ্যবিত্তরা পড়েছেন বিপাকে। নিম্ন বিত্তরা অন্যের কাছে হাত পেতে কিংবা লাইনে দাঁড়িয়ে সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা নিজেদের মূল্যবোধ ও আত্মসম্মানের কারণে ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করলেও কারো কাছে হাত পাততে পারে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ না পারে অভাব-অনটন সইতে, না পারে গলা উঁচিয়ে তা বলতে। কারণ তারা মানসম্মানের ফ্রেমে বন্দি। বিষয়টি এরকম, ‘করিতে পারি না কাজ/সদা ভয় সদা লাজ/পাছে লোকে কিছু বলে। বাজারে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। মধ্যবিত্তরা সঞ্চয় ভেঙ্গে কিছুদিন চললেও বাসা ভাড়া দিতেই অনেকে হিমশিম খাচ্ছে। যা বেতন পান তার অর্ধেকের বেশি চলে যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি বেতনে টেনেটুনে কোনো রকমে মাস পার করছেন। কিন্তু জীবনের বিপর্যর ঠেকাতে পারছেন না। গত বছর লকডাউনের সময় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। যা অনেকটা সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। কিন্তু এবারে ত্রাণ কার্যক্রম সেভাবে চোখে পড়ছে না। নুন আনতে পানতা ফুরোনো মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
এতদিন আমরা যে উন্নয়নের জোয়ারে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম তার খোলসটা করোনা উন্মোচন করে দিয়েছে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের বস্তুগত উন্নয়নের সংজ্ঞা কি? দেশটির চিকিৎসা, শিক্ষা ও মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন তা বিশ্লেষণ করলেই উন্নয়নের চিত্রটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে। একটি উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতার মাপকাঠি তিনটি। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি হ্রাস। বাংলাদেশে এই সূচকগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। জিডিপি, ঊর্ধ্বমুখী ইমারত, ওভারব্রিজ, বড় বড় দালানকোঠা, মেট্রোরেল যে জীবনমানের প্রকৃত নির্দেশক নয়, তা এখন খোলাসা হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রোরেল নিয়ে যত পরিকল্পনা হয়েছে তার সিকিভাগ যদি হাসপাতাল নিয়ে করা হতো তাহলে বিনাচিকিৎসায় মানুষের জীবন বিপন্ন হতো না। পুজিঁবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত পরিবার সবসময়ই বিপদে ছিল। জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে সেভাবে তাদের আয় বাড়েনি। উন্নয়নের শ্লোগান দিয়ে বাজিমাত করা অন্যায় কিছু না। ভারসাম্য উন্নয়ন হচ্ছে কি না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। উন্নয়ন হয়নি এটা বলছি না। কিন্তু উন্নয়নের জোয়ারে ধনিক শ্রেণির আয়তন ও জিডিপি বাড়ার সাথে সাথে কত নদী বিনাশ হলো, কত বন উজাড় হলো, বাতাস কত দূষিত হলো, মানুষের জীবন কত বিপন্ন হলো, নাগরিকদের বঞ্চনা ও বৈষম্য কত প্রকট হলো, বিরোধী মতালম্বীদের ওপর নিপীড়নের নিষ্ঠুরতা, এসব সমস্যা উন্নয়নের নামে জায়েজ করা মোটেও কাম্য হতে পারে না। গত বছরের মে মাসে একটি পত্রিকায় দেখলাম গত ১০ বছরে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে ধনী বাড়ার শীর্ষে স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশে ধনকুবেরের (৫০ লাখ ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী) সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ শীর্ষক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পুঁজিবাদের ফর্মুলা দিয়ে ধনী গরিবের বৈষম্যের সমাধান করা সম্ভব না। একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই কেবল মধ্যবিত্ত পরিবারের হাহাকার কিছুটা হলেও উপশম হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন