বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হচ্ছে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’। অর্থাৎ গ্রামে শহরের সকল সুযোগ সুবিধা-পৌঁছানো হবে। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রসংশনীয় ও বাস্তবধর্মী। এই উদ্যোগের আলোকে তৈরি করা হবে ৩০টি গাইড লাইন, ৫১টি সমীক্ষা প্রতিবেদন ও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিবিপি)। এছাড়া দেশের ৮৭ হাজার ২৩০টি গ্রাম উন্নয়নের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্কও তৈরি করা হবে। নির্বাচনী এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ‘কারিগরি সহায়তা’ নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩১ কোটি ৬ টাকা। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক তা অনুমোদিত হয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। আগামীতে তৈরি হতে যাওয়া অষ্টম পঞ্চ বার্ষিকী পরিচালনায় এ বিষয়ের প্রতিফলন দেখা যাবে। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের বিষয় হওয়ার কারণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বিষয়টি কার্য তালিকায় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। কারিগরি সহায়তা সংক্রান্ত এই প্রকল্পের আওতায় ৩০টি গাইড লাইন তৈরি করা হবে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মপরিধি সংক্রান্ত ৭টি বিষয় থাকবে। যেমন: গ্রামীণ যোগাযোগ, গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার বা হাটবাজার, গ্রামীণ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কমিউনিটি স্পেস ও বিনোদন, উপজলো মাস্টার প্লান, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও অন্য বিষয়সমূহ। এ ছাড়া আরও ৩৬টি সমীক্ষা পরিকল্পনা করা হবে। সেই সঙ্গে ১৫টি পাইলট গ্রামের আলাদা সমীক্ষা করা হবে।
এ সবরে মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জগুলো এবং উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন করা হবে। এছাড়া দেশের ৮টি বিভাগের সমতলের ৮টি গ্রাম এবং ডেলটা প্ল্যানের হট স্পট ও অর্থনৈতিক অঞ্চল সংলগ্ন ১৫টি গ্রামে পাইলট গ্রাম নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রকল্প তৈরি করা হবে। ভিশন ২০৪১ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য পল্লী অঞ্চলে অধিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঞ্চার করা হবে। কর্মসংস্থান তৈরির জন্য দেশের ৮৭ হাজার ২৩০টি গ্রাম উন্নয়নের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্কও তৈরি করা হবে।
প্রকল্প প্রস্তাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আধুনিক ব্যবস্থাপনায় গ্রামাঞ্চলের জনগণের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য গ্রামগুলোর শহরের আদলে রূপান্তর করা বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রস্তুতির জন্য প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। যেটি প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পটি হাতে নেয়া হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরামর্শক সেবা খাতে ২২ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিপিপিতে পরামর্শকের প্রয়োজনীয়, ক্যাটাগরি অনুযায়ী নাম, সংখ্যা, জন, মাস, কার্যপরিধি উল্লেখ করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে ২ কোটি টাকার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং স্থানীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এ ব্যয় বাদ দেয়া উচিত। স্থানীয় প্রশিক্ষণ খাতে ৫০ লক্ষ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় ও যুক্তিযুক্তভাবে হ্রাস করা প্রয়োজন রয়েছে। স্টেশনারী খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লক্ষ টাকার। প্রকল্প প্রাইস কন্টিসজেন্সি খাতে খরচ ধরা হয়েছে দেড় কোটি টাকা। প্রকল্পটি চলতি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বরাদ্দহীনভাবে অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই। তবে এটি প্রক্রিয়াকরণের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীর সম্মতি গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি জরুরি বিধায় এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের জন্য উদ্যোগটি খুবই সময় উপযোগী, জরুরি। সরকার ঠিক সময়ে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছেন। সরকারকে এই জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এখন জরুরি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
১. ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় ভিত্তিক টেকনিকেল কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। উক্ত কমিটি সকল দিক আলোচনা করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে, দেশের চাহিদা অনুযায়ী, দীর্ঘ মেয়াদী, পরিকল্পনার সুপারিশ করবে। তাতে ভুলভ্রান্তি হওয়ার আশঙ্কা থেকে আমরা বাঁচতে পারবো। প্রয়োজনে বিদেশি সহযোগিতাও নেয়া যেতে পারে। অভিজ্ঞতা বিনিময় করা- খুব ভালো হবে। পৃথিবীর সকল উন্নত দেশে আজ শহর গ্রামের কোনো পার্থক্য নাই। তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
২. বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারের বড় ছোট সকল উন্নয়নমূলক প্রকল্পে নানা অনিয়ম ঘটে চলেছে। কিছু কিছু ধরা পড়েছে। বিচারও চলেছে। কিন্তু অনিয়ম, দুনীর্তি বন্ধ হয় নাই। তবে হ্রাস পাওয়া উচিত। ভালো ভালো অর্জনকে এই সকল অনিয়ম, দুনীর্তি অনেক সময় ম্লান করে দেয়। তাই এই প্রকল্পে অনিয়ম, দুর্নীতি যাতে না ঘটে সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এই জন্য এই প্রকল্পের নিয়োজিত সকল কর্মকর্তার অতীত কার্যকলাপ দেখে নিয়োগ দেয়া উচিত।
৩. সকল প্রকার টেন্ডার ও ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এই জন্য কর্তাব্যক্তিদের ব্যক্তিগত শপথ নেয়া উচিত। এই প্রকল্পে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তার ‘আয়কর হিসাব’ সরকারকে গ্রহণ করে প্রতি বছর মূল্যায়নের ভিত্তিতে তার চাকরির পদোন্নতি নিশ্চিত করার নতুন নিয়ম চালু করা প্রয়োজন। তা হলে সকলে সৎ, নিষ্ঠাবান ও সততার সঙ্গে কাজে মনোযোগ দেবে।
৪. দরিদ্র মানুষের জন্য ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্প অত্যন্ত মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয়। যখন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে, তখন গ্রামে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান বেড়ে যাবে। দারিদ্র্য হ্রাস পাবে। মানুষ কর্মমুখী ও উপার্জনক্ষম হবে। তাই প্রকল্পটিকে স্বচ্ছ, দুনীর্তিমুক্ত, অনিয়মমুক্ত হতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি., অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন