শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সড়কে এতো মৃত্যুর দায় নেবে কে

প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবারের ঈদে সড়ক পথে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। ভয়াবহ যানজটে পথে পথে মানুষের ভোগান্তি ছিল অবর্ণনীয়। ঈদ আনন্দযাত্রা যাত্রীদের কাছে বেদনার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে আটকে থাকায় তাদের দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন। নারী-শিশু এক অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হয়। সীমাহীন দুর্দশা সয়েই তারা বাড়ি ফেরে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই সারাদেশে গত পাঁচ-ছয় দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে শতাধিক মানুষকে। এর মধ্যে একই পরিবারের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানসহ নিহত হওয়ার মতো মর্মন্তুদ ঘটনাও রয়েছে। ঈদের পর দিন রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় মাতাল অবস্থায় এক যুবক প্রাইভেট কার চালিয়ে এক দম্পতিকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। সারাদেশে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার সাথে এমন হৃদয়বিদারক আরও ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে। সব দুর্ঘটনার খবর পত্র-পত্রিকায় সবসময় আসে না। এর বাইরে দেশের আনাচে-কানাচে আরও অনেক আহত-নিহত হওয়ার খবর অগোচরে রয়ে যায়। ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনা এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা এবারের ঈদকে কিছুটা হলেও মøান করে দিয়েছে। ঈদের আগে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী একাধিকবার বলেছিলেন, এবার ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা মসৃণ ও নির্বিঘœ হবে। কোনো সমস্যা হবে না। যখন সমস্যা দেখা দিল, তখন তাকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। একেক সময় একেক কথা তিনি বলেছেন। শেষ পর্যন্ত ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ঈদ যাত্রার আগে তিনি যে আত্মবিশ্বাসের সাথে যাত্রা নির্বিঘœ করার কথা বলেছিলেন, তা ঠিক থাকল না কেন এবং কেন দুঃখ প্রকাশ করতে হলো? তিনি নিশ্চয়ই সড়ক পথে সমস্যা হবে না এমন সব ব্যবস্থা ও তথ্য নিয়েই আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপরও এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির দায় কি শুধু দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে এড়ানো যায়?
সড়ক পথে যাত্রীদের ভোগান্তি ও সড়ক দুর্ঘটনার এমন ভয়াবহ চিত্র গত ঈদুল ফিতরে দেখা যায়নি। অথচ আশঙ্কা করা হয়েছিল, ভর বর্ষা মৌসুমে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে। এ চিত্র যখন অনেকটাই নির্বিঘœ ছিল, তখন আশা করা হয়েছিল, এবারের ঈদযাত্রা আরও মসৃণ ও আরামদায়ক হবে। সড়ক-মহাসড়কের পরিস্থিতি উত্তম এবং সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এ আশায় যে গুঁড়ে বালি পড়েছে, তা ইতোমধ্যে সকলেই জেনেছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাওয়া এবং অসংখ্য মানুষের আহত-নিহত হওয়া। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, এবারের ঈদে সড়ক ব্যবস্থাপনা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। এ ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত হাইওয়ে পুলিশ, আন্তঃজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বলা বাহুল্য, স্বাভাবিক সময়েই সড়ক-মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। ঈদের বিশেষ ছুটির দিনগুলোতে সড়ক-মহাসড়কে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়বে, এটা আগে থেকেই জানা এবং অবধারিত। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে পড়ে। ভোগান্তি হবে না এবং সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে মন্ত্রীও আশ্বাস দেন। দুঃখের বিষয়, এবার তা পরিলক্ষিত হয়নি। যার ফলে লাখ লাখ ঘরমুখো মানুষের নিদারুণ দুর্ভোগে যেমন পড়তে হয়েছে, তেমনি দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়ে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। নির্বিঘœ ও মসৃণ যাত্রা এবং সড়কের সুব্যবস্থাপনার সাথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম থাকে। এবার এ ব্যবস্থাপনার চরম ঘাটতির কারণে যাত্রীদের ভোগান্তি এবং মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। এর দায় কে নেবে এবং এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে! সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিবারের স্বজন আহত এবং নিহত হয়েছে, সে পরিবারকে কী বলে সান্ত¦না দেয়া যেতে পারে! যে পরিবারটির একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি নিহত এবং আহত হলেন, সে পরিবারের দায়িত্ব কি কেউ নেয়? আমরা আজ পর্যন্ত শুনিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বা সরকার এই দায়-দায়িত্ব নিয়েছে। এমনকি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া চালকের টিকিটি পর্যন্ত ধরা যায় না। বেপরোয়া চালকদের নিয়ন্ত্রণে যথাযথ শাস্তির বিধান করে আইন করলেও তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকদের বিরোধিতায় বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতি হলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রিত হবে কিভাবে? দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই, এমন কথা মন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীলরা একাধিকবার বলেছেন। এ কথা যে দায় ও ব্যর্থতা এড়ানোর কৌশল, তা ন্যূনতম কা-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও জানে। অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনায় মানুষের হাত নেই, এটা যেমন সত্য, তেমনি দুর্ঘটনার প্রতিকারযোগ্য কারণগুলোও তো বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে শনাক্ত করেছেন। বেপরোয়া ড্রাইভিং, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, নিম্নমানের কাজ করা সড়ক, সড়কের নিয়ম-শৃঙ্খলা বা ট্র্যাফিক সিগন্যাল না মেনে এলোপাথাড়িভাবে গাড়ি চালানোÑ এসব কারণের কথা বহু বছর ধরে শনাক্ত হয়ে আসছে। এ কারণগুলোর সুষ্ঠু প্রতিকার না হওয়ার কারণেই তো সড়কপথগুলো মৃত্যুপথে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন মূল্যবান প্রাণ পথে ঝরে যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ দেশে ঠাঁই পেয়েছে।
ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষের যেমন ঢল নামে, তেমনি এসব মানুষকে পৌঁছে দেয়ার জন্য পরিবহন সংস্থাগুলো স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বাড়তি গাড়ির ব্যবস্থা করে। এই বাড়তি গাড়ি চালানোর জন্য বাড়তি যেসব চালকের প্রয়োজন হয় তারা কতটা দক্ষ, এ বিষয়টি সংর্শ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখভাল করে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যদি যথাযথভাবে খোঁজ-খবর নেয়া হতো তাহলে দেখা যেত এদের অনেকেই অদক্ষ এবং সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে অনুপযোগী। দক্ষ ও ধীরস্থির চালক হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি উল্টে যাওয়া, গর্তে পড়া, মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার মতো দুর্ঘটনা খুবই কম হতো। আমরা মনে করি, দুর্ঘটনার যেসব কারণ শনাক্ত হয়ে আছে, সেগুলো সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনকে সক্রিয় হতে হবে। এসব কারণের একটিও প্রতিকারহীন অবস্থায় রাখা যাবে না। জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে তার জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোনোভাবেই রাস্তায় নামতে দেয়া যাবে না। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ও বেপরোয়া চালকদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনুকম্পা দেখানো যাবে না। সবকিছু ঠিক আছে বলে আগেভাগে বক্তব্য দেয়ার চেয়ে কাজ করে দেখানোর ওপর সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দিতে হবে।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন