শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

ঈদ উৎসব ও সমসাময়িক ভাবনা

রাজশাহী ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০২১, ১:০৮ পিএম

ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ধনী-গরিব সবাই মিলেমিশে ঈদ উদযাপন করার ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের দেশে। কিন্তু পরপর দু'টো ঈদ অনেকাংশেই নিরানন্দে পরিণত হয়েছে মহামারী কোভিড-১৯ এর কারণে। লকডাউন ও সরকারী বিধি নিষেধের তোয়াক্কা না করে পথে পথে ঘর ফেরা মানুষের দীর্ঘ মিছিল। স্বাস্থ্যবিধি দারুনভাবে উপেক্ষিত। সড়ক-মহাসড়কে গণপরিবহন বন্ধ। জণদূর্ভোগ চরমে। যে যেভাবে পারছে ঘরে ফিরছে। বাড়িয়ে চলছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। বিপণন বিতনি গুলোর দিকে তাকালে মনেই হয়না আমরা কোন সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। ভারতের দ্বিতীয় টেন্ড ইতোমধ্যে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যা দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মনে চরম শংকা সৃষ্টি করলেও সাধারণ মানুষ অসচেতন। যেভাবে লক্ষলক্ষ মানুষ স্বাস্থ্যবিধিকে উপেক্ষা করে ট্রাক,মাইক্রোবাস, ভ্যান ও ছোটছোট যানবাহনে করে নাড়িরটানে গ্রামে ফিরছে তা যে ঈদ পরবর্তী গ্রামীন জণপদে করোনা ঝুঁকিকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্ত প্রশাসন নির্বিকার। মানুষের স্বাভাবিক চলাচল সংকোচিত করার সরকারি উদ্যোগ মোটেই সফল হয়নি। আর হবার কোন সম্ভাবনা নেই। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবারের ঈদে ঘরফেরা মানুষের দূর্ভোগ বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনাকালে একদিকে যেমন দেশে গরীব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অন্যদিকে বহুমানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। নিম্মআয়ের মানুষের ভোগান্তি দিনদিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকেই পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দুরে। স্বাভাবিক কারণেই তাদের কাছে এবারের ঈদটাও সুখকর হবে না। ঈদের নামাজ মাঠে নয় হবে মসজিদে। ঈদের দিনে অনেকেই নিজেদেরকে ঘরবন্দী করে ফেলবো। কারো বাসায় যাবো না। কাউকে আবার বাসায় ডাকবোও না। এমন ঈদ মুসলিম বিশ্ব আরেকবার দেখতে যাচ্ছে।

ঈদ আনন্দের ও খুশির উপলক্ষ হলেও আজ চারিদিকে শুধুই আতংক। শিক্ষার্থীদের মাঝে সেশন জটের আতংক, ক্ষুদ্র ব্যবসাযীদের মাঝে পুঁজি হারানোর আতঙ্ক। পেশাজীবিদের মাঝে পেশা হারানোর আতঙ্ক। করোনায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে সময়মত অক্সিজেন সিলিন্ডার না পাবার আতঙ্ক। এতসব আতঙ্কে আতঙ্কিত দেশের মানুষ। লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে ঘরমুখো মানুষের সীমাহীন দূর্ভোগ ও অর্থদন্ড এবারের ঈদ আনন্দকে অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ বিরোধীদলের প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। তাঁর অগনিত সমর্থক ও ভক্তদের ঈদ যে আনন্দের হবে না তা একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়। অন্যদিকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদন সরকার কতৃক প্রত্যাখ্যান হবার ঘটনা বিএনপির প্রতিটি নেতা কর্মীর মনে কষ্টের জন্মদিয়েছে। যে দেশে থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋৃনের পরিমান দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার এখনো বেগম পাড়ার সাহেবদের হদিস করতে পারছে না, গত একদশকে ব্যাংক বীমা থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। শেয়ারবাজর লুট করা হয়েছে। তখন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সরকারের এমন কঠোর মনোভাব তাঁর লক্ষকোটি সমর্থকের মনে যে যন্ত্রনার জন্মদিয়েছে তা তাদের ঈদ আনন্দকে বহুলাংশে কমিয়ে দিবে। সরকার বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সদয় আচরণ করে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ করে দিলে তা সর্বমহলে প্রশংসিত হতো। দেশে সৌহার্দ্যের রাজনীতির বাতাবরণ তৈরী হতো।
এদিকে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরদের নজিরবিহীন দুর্নীতি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায় যখন শুনি মেধা নয় চাকুরি দেয়া হয় দলীয় পরিচয়ে। দিনের পর দিন ক্যাম্পাসে না এসেও যখন ভিসির চেয়ারে বহাল তবিয়তে থাকা যায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কিই বা বলার থাকে। যখন দেখতে পাই চাকরি জীবন শেষ করে একজন সাবেক অতিরিক্ত সচিব একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরও শিক্ষকদের প্রতিবাদের ভাষা মিয়্রমান তখন সত্যি সত্যিই বড় কষ্ট হয়। যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত অধিকাংশ ভিসিরা ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতি,অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিতে নিমজ্জিত হয়ে শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা নষ্ট করছেন তাতে করে অদূরভবিষ্যতে মেধাবীরা শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে অবাক হবার কিছু থাকবেনা। ঈদ প্রতিবছর এক নতুন বার্তা নিয়ে আসে নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে। কিন্ত এবারও তার ব্যতিক্রম হতে চলেছে।
মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীনচেতা। মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। মানুষের শাশ্বত জন্মগত এই অধিকার যখন অন্যের দ্বারা ভূলুণ্ঠিত হয় তখনই সে প্রতিবাদ করে। সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নিজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শাসকদের বর্বরোচিত শোষণের নির্মম শিকার হতে হয়। পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মৃত্যুপণ সংগ্রাম শুরু করে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, তিরিশ লক্ষ শহীদ, আর দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম লাল সবুজের-পতাকা খচিত মানচিত্রের প্রিয় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্নবীজ রোপিত হয়েছিল মুলত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময়। পরবর্তীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালীদের উপর ক্রমাগত শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যমূলক আচরণ, ন্যায্য অধিকার প্রদানে অস্বীকৃতি স্বাধীনতার আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। বঞ্চিত বাঙালি জাতি অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আস্তে আস্তে সক্রিয় হয়ে উঠে। ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম ১৯৭১ সালে এসে অনিবার্য মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ নামক’ ভূখন্ড।

স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ও অসা¤প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবিক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মানুষের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু আজ বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? কি দেখার কথা ছিলো আর কি দেখছি?

‘কি দেখার কথা কি দেখছি. . .... তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি. . .’ স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে গায়ক হায়দার হোসেনের এই গানটিই যেন আজ করুণ সুরে বেজে ওঠে প্রতিটি মানুষের মনের কোণে। তিরিশ নয়, পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আজ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি । শোষনহীন সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রীক রাষ্ট্র ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বের দুর্বিপাকে এখনও আমরা কমবেশি ঘুরপাক খাচ্ছি। মূল্যবোধের অবক্ষয়, হিংসাত্মক অপরাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার, অর্থ তছরুপ, প্রভৃতি অনৈতিক কর্মকান্ড স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরে আছে। দেশে নতুন নতুন রাস্তা ঘাট ব্রিজ মেট্রোরেল নির্মাণ হচ্ছে। অর্থনীতি বড় হয়েছে। পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হয়েছি সত্য, তবে সুশাসন ও ন্যায়বিচার এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। অর্থপাচর, বালিশকান্ড, ব্যাংকিং খাতের অনিয়- দূর্ণীতি, বেগমপাড়া ও সেকেন্ড হোমে বসতবাড়ী নির্মাণ, মহামারি করোনা কালে স্বাস্থ্যখাতের দুর্ণীতি দেশে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তিকে দারুনভাবে ক্ষুন্ন করছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিলো মুক্ত গণতন্ত্র ও মানুষের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বহীন আচরণ ও বহুবিধ বিতর্কিত কর্মকান্ডের জেরে উৎসবের ভোট আজ নিরানন্দে পরিনত হয়েছে। মানুষ দেশের ভোটব্যবস্থা থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নাগরিকের বাকস্বাধীনতা অনেকটাই সীমিত। ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টস এর অপপ্রয়োগ দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। আর এসব কারণে স্বাধীনতার চেতনা আজ অনেকটাই ম্লান হয়ে যেতে বসেছে। এসব সংকট থেকে জাতি মুক্তি চায়।

সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশার কথা হলো, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। মানুষের বানানো মনগড়া ইতিহাস নয় বরং তরুন প্রজন্মের হাতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে দেয়া জরুরি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস সংগ্রহের মাধ্যমে ইতিহাসবিকৃতি রোধের উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। দল কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চা করতে হবে।

লেখকঃ প্রফেসর ড. মোহাঃ হাছানাত আলী
আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন