ঈদ আনন্দ আর করোনা মহামারীর শংকার মধ্যদিয়েই আম লিচু জাম কাঠালের মন মাতানো সৌরভ আর কৃষ্ণচুড়ার আবির ছড়িয়ে যাত্রা শুরু করল গ্রীস্মদুহিতা মধুমাস জ্যৈষ্ঠ। গোলাপি আভার আম লিচু কাঁচা সোনা রংয়ের কাঠাল সৌরভ ছড়ানো বাঙ্গিসহ কতইনা ফল ফলারীর সমারোহ। বৈশাখে প্রচন্ড খরতাপের পর মাঝারী খরতাপ মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলো জ্যৈষ্ঠ মাস। বিরুপ আবহাওয়ায় জীবন যাত্রা খানিকটা বিপর্যস্ত হলেও প্রকৃতিতে কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়া, গগন চুড়ায় লাল রংয়ের চোখ ধাধানো আগুন লাগে। লাল গুলমোহর হলদিয়া জারুল মন উদাস করে এ জ্যৈষ্ঠে। মন গুন গুনিয়ে ওঠে কৃষ্ণ চুড়া লাল হয়েছে ফুলে ফুলে তুমি আসবে বলে ......। শুধু চোখ ধাঁধানো ফুল নয়। চারিদিকে থরে বিথরে সাজানো ফলের সমারোহ। এ মাসের বৈশিষ্ট হলো একদিকে গরম প্রকৃতি। গুমোট গরম দম বন্ধকর অবস্থা অন্যদিকে উদার প্রকৃতি গরমে কাহিল হওয়া মানুষের পরিতৃপ্তি আর প্রশান্তির জন্য নানা ফল ফলারীর আগমন।
গ্রীস্ম মওসুমে গরম আবহাওয়া থাকবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। প্রান ওষ্টাগত করে তোলা আদম সন্তানের প্রশান্তির জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার রহমত ও নিয়ামতের ঝুড়ি থেকে এ সময়ের ফল হিসাবে আসে আম জাম লিচু তরমুজ বেল বাঙ্গী আনারসসহ হরেক রকমের ফল ফলারী। যা খরা ক্লিষ্ট মানুষের তৃষ্ণা মেটায়। দেহ মনে প্রশান্তি আনে। জ্যৈষ্ঠ মাসে সর্বপ্রিয় মধুফল আম লিচুর সমারোহ বেশী থাকে বলে এ মাস ঘিরেই চলে নানা ধরনের উৎসব। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের কাছে যায় আম লিচুর ঝুড়ি। মান অভিমান ভাঙ্গাতে আম লিচুর ঝুড়ি অত্যন্ত কার্যকরি।
রাজশাহী অঞ্চলের বাইরের বন্ধু বান্ধবীরা সহকর্মীরা আশাকরে আম আসবে। এখন থেকে কৌশলে মোবাইলে একথা ওকথা বলার পর জিজ্ঞেস করে আমের খবর কি ? এ যেন আকেলমান্দ কে লিয়ে ইশারায় কাফি। আগে আমকে ঘিরে বিভিন্ন দপ্তরের কর্তাদের ট্যুর শুরু হতো। যাকে বলে ম্যাঙ্গো ট্যুর। যদিও গত বছর থেকে করোনার কারনে তাতে ছন্দপতন ঘটেছে। এরপরও ঝুড়ি ঝুড়ি আম যাবে রাজনৈতিক নেতা নেত্রী, মন্ত্রী এমপি হোমড়া চোমড়াদের কাছে। বিভিন্ন প্রকল্পের ফাইল সচল করতেও আমের ঝুড়ির চালান যাবে। আরো নানা কাজে ব্যবহার হবে আম ভর্তি ঝুড়ি। আম পরিবহনের জন্য কুরিয়ার সার্ভিসগুলো প্রস্তুতি নিয়েছে। আম চাষীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্তনা হয় সেজন্য গতবছর রেলওয়ে চালু করেছিল ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন। এবারো হয়তো তা হতে পারে।
এবার জ্যৈষ্ঠের প্রথমদিন থেকে শুরু হচ্ছে আম পাড়া। শুরুতেই নানা জাতের গুটি আম দিয়ে যাত্রা শুরু করছে। এরপর পয্যায়ক্রমে আসতে থাকবে বনেদী জাতের গোপালভোগ, রানীপছন্দ, ক্ষিরসাপাতি, ল্যাংড়া, আ¤্রপালিসহ নানা নামের আম। বউ সোহাগী, বউভোলানা, নবাবপছন্দ, বেগম পছন্দ, হাড়িভাঙ্গা কত নামের আম তার ঠিক নেই।
এবার খরতাপের মাত্রা একটু বেশী বলে আগেভাগে কিছু কিছু গাছে আমের রং হলুদ বর্ন ধারন করেছে। গরমে আম পেকে গেছে বলে তা নামানোর প্রস্তুতি চলছে। টক মিষ্ট স্বাদের গুটি আম সাধারনত নি¤œ আয়ের মানুষের তৃষ্ণা মেটায়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে বেশকটি জুস, জ্যাম, জেলী কোম্পানী তাদের শাখা কারখানা চালু করেছে। ফলে এসব কোম্পানীর লোকজন কমদামে সব কিনে নিচ্ছে। ফলে নি¤œআয়ের মানুষ আমের স্বাদ খুব একটা নিতে পারছেনা।
মধুমাস শুরু হওয়ায় এ অঞ্চলের আম অর্থনীতির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আম আবাদ হচ্ছে বানিজ্যিক ভিত্তিতে। বাড়ছে বাগান। আড়তগুলো ঝেড়ে মুছে প্রস্তুত করা হচ্ছে। খাঁচি, টুকরি তৈরী হচ্ছে। আম পাড়া পরিবহন, প্যাকিংসহ সংশ্লিষ্ট কাজের প্রস্তুতি চলছে। মাস চারেকের জন্য এখানকার আম অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে। লাখো মানুষ প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে ব্যাস্ত থাকবে মধুমাস নিয়ে। বানিজ্য হবে হাজার কোটি টাকার।
পাকা আম আসতে কিছুদিন দেরী হলেও এখন কাঁচা আমে বাজার ভরা। মাসখানেক ধরেই বাজারে কাঁচা আম (করালী)। পাড়া মহল্লায় কাক ডাকা ভোর হতে বিক্রেতাদের হাঁকডাক আম নিবেন গো আম। কাঁচা আমের দাম খুব একটা বেশী নয় আট দশ টাকা কেজিতে মিলছে এ আম। এসব আম দিয়ে ছোট মাছ রান্না, শোল মাছ রান্না, ডাল দিয়ে আম, আমের টকসহ রকমারী স্বাদের রান্না চলছে। গৃহীনিরা ব্যাস্ত কাঁচা আম দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আচার বানাতে। বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদে আম কেটে শুকানোর দৃশ্য নজর এড়ায়না। সারা বছর ব্যবহারের জন্য আমচুর করা হচ্ছে। মেয়েদের পছন্দ কাঁচা আম লবন মরিচ মেখে খাওয়া। রোজাদাররা খরতাপের তৃষ্ণা নিবারনে কাঁচা আমের সাথে পুদিনা পাতা আর বিট লবন দিয়ে জুস তৈরী করে পান করেন। তৃষ্ণা নিবারনে স্বাদে গুনে অন্যন্য এ এক জুস। আর পাকা আমের তো কথায় নেই। কাঁচা পাকা আমের জুস করোনা রোগিদের জন্য একটি পথ্য।
পৃথিবীজুড়ে আমের জনপ্রিয়তা বৈচিত্রপূর্ন ব্যবহার স্বাদ ও পুষ্টি মানের বিবেচনায় এটি একটি আদর্শ ফল। আম কেবল খাদ্যগুনে সমৃদ্ধ তা নয়। বিউটিশিয়ানদের মতে ত্বকের সৌদর্য্য রক্ষায় ভাল ভূমিকা রাখে। যাদেও ত্বক ফ্যাকাশে ও উজ্জলতা হারিয়েছে তারা প্রতিদিন পাকা আমের রস দুধের সাথে খেলে ত্বক উজ্জল হবে। খসখসে পুরানো ত্বকে নিয়মিত রসাল আমের রস গলিয়ে মুখে ত্বক ফিরে পাবে লাবন্য। এরপর ঔষধী গুনতো আছেই।
যারা ডায়াবেটিক ও হৃদরোগের কারনে আম খাননা। তাদের জন্য সুখবর এনেছেন আমেরিকার কিছু গবেষক। তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন নিয়মিত আম খেলে শরীরে খারাপ কোলেষ্টরেল মাত্রা কমে। স্বাভাবিক ভাবে হার্ট এ্যাটাকের আশংকা কম হয়। অষ্ট্রেলিয়ান গবেষক বলছেন আমে থাকা বেশকিছু বায়ো-এ্যাকটিভ কম্পাউন্ড নানাভাবে শরীরের উপকার করে। বিশেষ করে ক্যান্সার প্রতিরোধ করার পাশপাশি একাধিক রোগ থেকে আপনাকে বাঁচাবে। একাধিক গবেষনায় পাওয়া গেছে টানা বারো সপ্তাহ এক টুকরো করে আম খেলে রক্তের শর্করার মাত্রা কমতে শুরু করে। ফলে ডায়াবেটিসের মত রোগ কাছে আসতে পারেনা। আমের উপস্থিত ফাইবার এবং অন্যান্য এন্টি-ডায়াবেটিক প্রপাটিজ এক্ষত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শরীরে এ্যসিডের ভারসাম্য বজায় রাখে। আমের মধ্যে থাকা টার্টেরিক ম্যালিক এবং সাইট্রিক এ্যসিড শরীরের অন্দরে এ্যালকালাইন ব্যালেন্স ঠিক রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আম হজম শক্তি বাড়ায়। আমে বিশেষ এক ধরনের এনজাইমের উপস্থিতি রয়েছে যা খাবার হজমে সহায়ক। চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে আমের ভিটামিন এ বিশেষ ভূমিকা রাখে। আম আমাদের শিল্প সাহিত্যে এক বিশাল স্থান দখল করে আছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ কবিরা আম নিয়ে যত গল্প কবিতা কৌতুক লিখেছেন এমনটি আর অন্য ফলের ভাগ্যে জোটেনি। আমাদের জাতীয় সংগীতে ঠাই পেয়েছে আম। ওমা ফাগুনেতে আমের বনে ঘ্রানে.......। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম জ্যৈষ্ঠের এগারো তারিখে। জাতীয় কবির জন্মমাস হিসাবেও জ্যৈষ্ঠ পেয়েছে অন্যরকম মর্যাদা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন