এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশে। আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা অববাহিকার পানি। এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-১৬ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জাতীয় পানি নিরাপত্তা ইনডেক্সে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ কিরিবাতি। পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাটির ওপরের ও নিচের দু’ধরনের পানির অবস্থাই খারাপ। মাটির নিচের পানি উত্তোলনের প্রবণতা বাংলাদেশে অনেক বেশি। বাংলাদেশে প্রতি বছর ভূগর্ভ থেকে ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয়, যার ৮৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে, অবশিষ্ট গৃহস্থালি কাজে। ভূগর্ভস্থ থেকে এত ব্যাপক হারে উত্তোলনের ফলে পরিবেশগত ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে মাটির ওপরের পানি বিশেষত নদী-জলাশয়ের পানি মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর শহর ও শিল্পাঞ্চলের ৮০ শতাংশ পয়োঃবর্জ্য কোনো শোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় এর শহর ও শিল্পাঞ্চলের পয়োঃ ও রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদী-জলাশয়েই পতিত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, রাজধানীর চারদিক দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো পয়োঃ ও রাসায়নিক বর্জ্যে এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে, এসব নদীর পানি অনেক আগেই ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে। বুড়িগঙ্গা রীতিমতো বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এর দূষণের বড় কারণ হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প। বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্য ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলেও আজো স্থানান্তর সম্ভব হয়নি। সাভারের যে এলাকায় স্থানান্তর করা হবে সে এলাকায় এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি হয়নি। জানা গেছে, প্রতিদিন হাজারীবাগ থেকে ২১ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পতিত হয়। বুড়িগঙ্গা কেন, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যায়ও প্রতিদিন নির্বিচারে বর্জ্য পতিত হচ্ছে। দেশের অন্যান্য নগরী ও শিল্পাঞ্চলের আশপাশের নদী-জলাশয়ও একই পরিস্থিতির শিকার।
মাটির ওপরের ও নিচের পানির যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বলাই বাহুল্য, তাতে এমন এক সময় আসতে পারে যখন পানিযোগ্য ও ব্যবহারযোগ্য পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, মাটির নিচের পানিও আর এখন যথেষ্ট নিরাপদ নয়। ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ইতোমধ্যে অনেক নিচে নেমে গেছে। ভূগর্ভে পানি সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে অপরিমেয় আর্সেনিক মিশ্রণ ঘটেছে। আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পানযোগ্য নয় এবং ফসলাদি আবাদের জন্যও উপযুক্ত নয়। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি মানুষের জন্য যেমন অপরিহার্য তেমন জীবজন্তু, বৃক্ষলতা, ফসলের জন্যও অপরিহার্য। দূষিত পানি রোগ-ব্যাধির প্রধান কারণ। এটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি জীবজন্তু, বৃক্ষলতা ও ফসলের ক্ষেত্রেও সত্য। কৃষি উৎপাদন হোক বা শিল্পোৎপাদন হোক, বিশুদ্ধ পানির বিকল্প নেই। পানি নিরাপত্তার অভাবে যে কোনো দেশের তা যত বড় অর্থনীতিই হোক, ভেঙে পড়তে বাধ্য। বিশুদ্ধ পানি ছাড়া সবকিছুই অচল। এমতাবস্থায়, প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানির সংস্থান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির সংস্থান ও যোগান নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই ওপরের ও নিচের পানি দূষণমুক্ত করতে হবে। নদী ও জলাশয়ের পানি দূষণমুক্ত করা বা দূষণ থেকে নিরাপদ করা গেলে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতাও কমাতে পারে। কাজেই সর্বাগ্রে নদী-জলাশয় দূষণমুক্ত করতে হবে, দূষণের প্রক্রিয়া রহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জন ও জাতীয় স্বার্থেই এই পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন জরুরি।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, পানির পাশাপাশি বায়ু দূষণও বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে মানুষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছে নানা প্রকার বিষ ও স্বাস্থ্যহানিকর উপাদান। এ কারণে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ ক্রমবর্ধমান। নির্বিচারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটিও দূষণের কবলমুক্ত নয়। বলা যায়, পরিবেশের সব মৌলিক উপাদানই কোনো না কোনোভাবে দূষণের শিকার। এই সঙ্গে ফল, ফসলও দূষণযুক্ত। তাতে বিভিন্ন প্রকার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে রাখার জন্য উপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য হলেও কোনো ক্ষেত্রেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। কোনো কোনো বর্জ্যরে ক্ষেত্রে কোনোরূপ পরিকাঠামোই নেই। এ প্রসঙ্গে ই-বর্জ্যরে কথা উল্লেখ করা যায়। এটি পরিবেশের ওপর নতুন উপসর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিদিন কয়েক শত টন ই-বর্জ্য তৈরি হলেও তা ধ্বংস, রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার কোনো পরিকাঠামো নেই। এটা নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপদ খাদ্য, পানি, বায়ু, মাটি ইত্যাদি মানুষের জন্যই নয়, জীব ও প্রাণিকুলের জন্যও অপরিহার্য। পরিবেশের এসব উপাদান দূষণমুক্ত রাখা সকল প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য, সভ্যতার জন্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য একান্তভাবেই আবশ্যক। এদিকে নজর দেয়া এখন সময়েরই একটি বড় দাবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন