এবার কোরবানির চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও কেনাবেচা নিয়ে এক ধরনের হরিলুটের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কারসাজির কারণে মাদরাসায় পড়–য়া এতিম, অসহায় ও গরীবদের হক মেরে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনিতেই উক্ত ব্যবসায়ীরা এ বছর গরু ও ছাগলের প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য স্মরণকালের সবচেয়ে কম নির্ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দরপতনের অজুহাত দেখিয়ে তারা তাদের ইচ্ছামতো দাম ধার্য করে। গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়া ৫০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০ টাকা ধরা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে গরুর প্রতি বর্গফুট ফিনিশড চামড়ার মূল্য ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, যা প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ ৪০ শতাংশ বাদ দিয়ে দাঁড়ায় ৯৬ টাকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কোরবানির চামড়ার প্রতি বর্গফুটের মূল্য ৯৬ টাকা ধরা উচিত ছিল। এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতেও প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য ৯০ টাকা। দেখা যাচ্ছে, ট্যানারি মালিকসহ চামড়া ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনের যে দোহাই দিচ্ছেন, তা মোটেও সঠিক নয়। অসত্য তথ্য ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ এবং কম দাম নির্ধারণ থেকে তাদের অতি মুনাফালোভী মনোভাবের বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা তাদের ষোল আনা উসুল করে আরও অধিক লাভ করে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের এই লাভ আসছে অসহায় এতিম ও গরীবদের হক মেরে দেয়ার মধ্য দিয়ে, যা কোনোভাবেই মানবিকতার মধ্যে পড়ে না।
চামড়ার দাম নির্ধারণ ও কেনাবেচা নিয়ে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের যেমন খুশি তেমন সিদ্ধান্তের বিষয়টি নতুন নয়। প্রতি বছরই তারা তাদের ইচ্ছামতো সবকিছু করে। বলা যায়, মাঠ পর্যায়ে যেসব চামড়া সংগ্রাহক ও ব্যবসায়ী রয়েছে, তারা ট্যানারি মালিক ও সংশ্লিষ্টদের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে রয়েছে। এ বছর এমনই পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মৌসুমী ব্যবসায়ী ও সংগ্রাহকদের পথে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। চামড়া ব্যবসার সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদে বছরের ৬০ শতাংশ চামড়া সংগৃহীত হয়। কোরবানিদাতারা চামড়া ও তার মূল্য মাদরাসা পড়–য়া এতিম, অসহায় ও গরীবদের দান করে। এটা তাদের হক। দুঃখের বিষয়, এ বছর এ হকে হাত দিয়েছে ধনিক শ্রেণীর ট্যানারিওয়ালা ও তাদের সিন্ডিকেট। সাধারণত কোরবানির চামড়ার মূল্য দিয়ে দেশের মাদরাসাগুলো বছরের ৫ থেকে ৬ মাস সার্বিক পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করে। এ বছর ট্যানারি মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অবৈধ মুনাফা লুটের কারণে মাদরাসাগুলোর ব্যয় দেড় মাসও চালানো যাবে না বলে মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন। ট্যানারি মালিক ও সংশ্লিষ্টদের নীতি-নৈতিকতা এবং মানবিকতার কতটা অবক্ষয় ঘটলে এ কাজ তারা করতে পারে, সহজেই অনুমেয়। এতিম ও দরিদ্রদের হক মেরে বড় লোক থেকে আরও বড় লোক হওয়ার এই প্রবণতা দেখে দুঃখিত না হয়ে পারা যায় না। ন্যূনতম বিবেক ও মানবিকতা থাকলে কেউ এই ধরনের কাজ করতে পারে না। অথচ ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকরা শত শত কোটি টাকার মালিক। সরকারের কাছ থেকেও ব্যাংক লোনসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছে। এমনকি ব্যাংকের অর্থ মেরে দেয়ার অভিযোগও কারো কারো বিরুদ্ধে রয়েছে। এত কিছুর পরও তাদের লোভের পাগলা ঘোড়া এতিম-দরিদ্রদের হকের উপর দাবড়িয়ে দিয়েছে। এতে দেশের সচেতন ও মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। মাদরাসা সংশ্লিষ্টরাও ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, গরীব ও অসহায়ের হক রক্ষার দায়িত্ব সবার। ট্যানারিওয়ালারা প্রতি বছরই নানা অজুহাতে এ হকের বড় অংশ খেয়ে ফেলছে। এভাবে গরীবের হক সবলের দখলে যাওয়া দেখে আমরা বসে থাকতে পারি না। তাদের এই ক্ষুব্ধতা প্রকাশ যথাযথ এবং যু্িক্তযুক্ত। এই ক্ষুব্ধতা থেকেই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী মৌসুম থেকে সংগৃহীত চামড়া দেশের বিভিন্ন মাদরাসার তত্ত্বাবধানে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এমনকি ভবিষ্যতে একটি ট্যানারি স্থাপনের পরিকল্পনাও করছেন। নিজেরাই সরাসরি রপ্তানি বাজারে যাবেন বলেও আশা প্রকাশ করছেন। চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও কেনা নিয়ে ট্যানারি মালিক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কারসাজির বিষয়টি এবার প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, বাজারে চামড়ার দাম বেঁধে দেয়াই ঠিক হয়নি। যে দাম নির্ধারণ করা হয় সেটি সঠিক হয় না। প্রচলিত দামও অনেকে মেনে চলে না। এতে চামড়ার ন্যায্যমূল্য যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটও অনৈতিক এবং অতি মানুফার সুযোগ পায়। অন্যদিকে চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম কম নির্ধারণ করায় পাচারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশে চামড়ার দাম বেশি হওয়ায় দেশটির চামড়া ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে কম দামে কিনে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বলে ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, চামড়া পাচার ঠেকাতে সীমান্তে সরকার রেড এলার্ট জারি করেছে, তারপরও চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়ায় এ ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বলা বাহুল্য, চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকরা যদি অতি মুনাফালোভী না হত, তবে এ ধরনের আশঙ্কার সৃষ্টি হতো না।
ট্যানারি মালিক ও সংশ্লিষ্ট চামড়া ব্যবসায়ীদের অর্থ-বিত্তের অভাব নেই। তবে এতিম ও গরীবদের হক নিয়ে ছিনিমিনি এবং মেরে দেয়ার প্রবণতা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, তাদের মধ্যে মনুষত্বের অভাব দেখা দিয়েছে। তা না হলে এ কাজ করা সম্ভব হতো না। তাদের এ প্রবণতায় সচেতন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, তারা আর কি চায়? তাদের আর কত অর্থের প্রয়োজন? এতিম ও গরীবের হক মেরে দেয়ার মধ্যে কি কৃতিত্ব থাকতে পারে? আমরা মনে করি, ট্যানারি মালিক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের এতিম ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মহান বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চামড়ার ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়া উচিত। চামড়া পাচার ও পচে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে তাদের এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন