স্টাফ রিপোর্টার : স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের পর বড় ধরনের যানজট ছাড়াই রাজধানীতে ফিরছেন কর্মস্থলমুখী মানুষ। তবে দেশের নানা স্থান থেকে ঢাকামুখী যানবাহনগুলো বিভিন্ন ফেরিঘাটে এসে পড়তে হয়েছে দীর্ঘ ভোগান্তিতে। কোথাও কোথাও সময়মত ফেরি পাওয়া যায়নি। আবার কাথাও কোথাও ঘাট সঙ্কটের কারণে ফেরি পারাপারের জন্য বসে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফেরি পারাপারের দীর্ঘ ভোগান্তির পর যানবাহনগুলো রাজধানী শহর ঢাকায় প্রবেশ করতে তেমন একটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি বলে জানা গেছে। গাবতলী, কল্যাণপুর ও শ্যামলীর কাউন্টারগুলোতে এজন্য স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা গেছে তাদের। গতকাল শনিবার সকালে গাবতলী বাস টার্মিনাল এবং কল্যাণপুর-শ্যামলীর কাউন্টারগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, হানিফ, শ্যামলী, এস আলম, সোহাগ, কেয়া, হিমেল, ডিপজল পরিবহন ও লোকাল পরিবহনের বাসগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক কাউন্টারে আসছে।
হানিফ পরিবহনে ঢাকায় আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ফাহিম জানান, ঈদের আনন্দ শেষে শুক্রবার রাত ১২টায় ঠাকুরগাঁও থেকে রওনা দেন তিনি। যমুনা সেতুর পর কোনো রকম জ্যাম ছাড়াই সকাল দশটায় ঢাকায় এসে পৌঁছেন।
বগুড়া থেকে আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশিকুর রহমান জানান, কোনো রকম জ্যাম ছাড়াই শ্যামলী পরিবহনে মাত্র সাড়ে ৪ ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছেছেন।
হানিফ পরিবহনের সুপারভাইজার রবিউল ইসলাম বলেন, রাত ১১টা ৪০ মিনিটে পঞ্চগড় থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে বাসটি। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের মাঝামাঝি চান্দাইলে কিছুক্ষণ জ্যামে থাকায় ১০ ঘণ্টায় ঢাকায় আসতে হয়েছে। তবে ঈদের আগের দিনগুলোতে সিরাজগঞ্জ থেকে গাবতলী পর্যন্ত আসতেই ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লেগেছে। সে তুলনায় অনেকটা আরামেই চলে এসেছি।
শুকতারা পরিবহনে মানিকগঞ্জ থেকে গাবতলীতে আসা শাহজাদপুরের বাসিন্দা তিন সন্তানের জননী সুলতানা রাজিয়া জানান, কোনো রকম জ্যাম ছাড়াই মাত্র ২ ঘণ্টায় গাবতলীতে এসেছেন। বাড়ির সবাইকে নিয়ে ঈদ উদযাপনের পর কোনো ঝামেলা ছাড়াই ঢাকায় পৌঁছাতে পেরে অনেক ভালো লাগছে।
তার ৪ বছরের সন্তান জাইদি বলেন, এবার ঈদে আমি অনেক মজা করেছি। আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। মানিকগঞ্জ থেকে মায়ের সঙ্গে আসা মিরপুর ১০ নম্বরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র দেওয়ান জানান, খুব অল্প সময়ে চলে এসেছেন।
কেয়া, হিমেল ও সৈকত পরিবহনের যাত্রীরাও অল্প সময়ে ঢাকা আসতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে যাত্রী কমে গেছে। এখন যারা গাবতলী থেকে বাসে যাত্রা করছেন তাদের বেশিরভাগই খুব জরুরি প্রয়োজনে যাচ্ছেন। বাকিরা ঢাকায় ঈদ উদযাপন শেষে কর্মস্থলে ফিরছেন।
এদিকে গতকাল শনিবার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের উভয় পাড়ে ঈদের ছুটি শেষে রাজধানীমুখী মানুষের বাড়তি চাপ দেখা গেছে। ঘাটের দৌলতদিয়া প্রান্তে ফেরি পারাপারে বাস ও ছোট গাড়ির যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়লেও লোকাল যাত্রীরা ফেরি বা লঞ্চে করে নৌরুট পারাপার হয়েছেন অনায়াসে। এসব লোকাল যাত্রীদের জন্যে পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকার জিরো পয়েন্টে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে রাজধানী ও গাজীপুরগামী অনেক যাত্রীবাহী বাস। ফেরি বা লঞ্চ পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় নোঙর করা মাত্রই যানবাহনের শ্রমিকরা ডাক হাঁকাচ্ছেন ভেতরে দুইশ, ছাদে একশ।
নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে অধিকাংশ যাত্রী বাসের ভেতরের ছিটে বসে এবং দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা যাচ্ছেন ছাদে। রাজবাড়ী সদর উপজেলার ময়নাল হোসেন বলেন, পরিবার নিয়ে ঈদ করে ঢাকায় ফিরছি। ঈদে টাকা-পয়সা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই বাসের ছাদে বসে ঢাকা যেতে হচ্ছে।
নিরাপত্তার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাখে আল্লাহ মারে কে।
গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক ফিরোজ মিয়া জানান, পাটুরিয়া থেকে গাজীপুরে গাড়ির ভেতরে ছিটে বসে গেলে ২০০ টাকা লাগবে। কিন্তু ছাদে মাত্র ১০০ টাকা। তাই তিনিসহ তার কয়েকজন সহকর্মী ছাদে বসে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে বরংগাইল হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইয়ামিন উদ দৌলা জানান, ছাদে যাত্রী নেয়ায় বেশ কয়েকটি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। আমাদের চেকপোস্টগুলো এ ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
গতকাল শনিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি ঘাটে কর্মস্থলমুখী যাত্রীদের চাপ বেড়ে যায়। শিমুলিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন পাটোয়ারী জানান, সকাল থেকে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের চাপ বাড়ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী এবং যানবাহনের চাপ বাড়তে শুরু করেছে শিমুলিয়ায়। পাঁচটি রো রো ফেরিসহ ১৭টি ফেরি পারাপার স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। যাত্রীদের চাপ কম থাকলে পণ্যবাহী যানবাহনগুলো ফেরিতে পারাপার করা হচ্ছে।
মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোশারফ হোসেন জানান, শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় অল্প গাড়ি কাওড়াকান্দি পৌঁছানোর অপেক্ষায় রয়েছে। নির্বিঘেœ যাত্রীদের পারাপার করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কামরুজ্জামান রাজ জানান, মুন্সীগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশে যানবাহনের চাপ নেই। মহাসড়কে প্রাইভেট কারের সংখ্যাই বেশি। ঈদের ছুটি শেষে তৃতীয় দিনেও মহাসড়কে যানজট না থাকায় ভোগান্তি ছাড়াই যাত্রীরা কর্মস্থলে ফিরছেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে দৌলতদিয়া ঘাটে নদী পারের অপেক্ষায় আটকে পড়েছে বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ দুই সহ¯্রাধিক বিভিন্ন গাড়ি। ফেরিঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে আটকাপড়া যানবাহনের দীর্ঘ জট।
যানজটের কারণে মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীরা গোয়ালন্দ বাজার এলাকায় গাড়ি থেকে নেমে রিকশা, অটোরিশা ও মাহিন্দ্রতে করে চর দৌলতদিয়ার হামিদ মৃধার হাট হয়ে ফেরিঘাটে যাচ্ছেন। রোদ ও গরমের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যাগ ও লাগেজ নিয়ে অনেকে পায়ে হেঁটেও যাচ্ছেন লঞ্চ, ফেরি ও ট্রলারঘাটে।
দৌলতদিয়া ঘাটে যেতে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করায় যাত্রীদের ঘুরতে হচ্ছে ১২ কিলোমিটার। পুলিশ এ সড়ক দিয়ে পাঠাচ্ছে প্রাইভেটকারসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত গাড়িগুলোও। কুষ্টিয়া থেকে একতা পরিবহনে দৌলতদিয়া ঘাটে এসেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোহাম্মদ লোকমান হোসেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় যেতে ঘাটে এসে যানজটে আটকা পড়েছেন। কখন নদী পার হতে পারবেন ঠিক করে বলতে পারছেন না তিনি। গরমের মধ্যে গাড়িতে বসে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
খুলনা থেকে আসা ঈগল পরিবহনের চালক আবুল খায়ের বলেন, শুক্রবার দিনগত রাত ১২টায় দৌলতদিয়া মডেল হাইস্কুলের সামনে এসে আটকা পড়েন তিনি। গতকাল শনিবার বেলা ১১টার দিকে ফেরির নাগাল পেয়েছেন।
তাদের মতোই সহ¯্রাধিক যানবাহনের চালক যাত্রীদের নিয়ে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় আটকা পড়েছেন। ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার আগে কোনো যানবাহনই নদী পার হতে পারছে না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থার (বিআইডবিøউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে দৌলতদিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ২ নম্বর ঘাটটি ভাঙনের কবলে পড়ে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে ৪ নম্বর ঘাটটিও। চারটি ফেরিঘাটের মধ্যে দু’টি বন্ধ থাকায় ঘাট সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। ৪ নম্বর ঘাটটি চালু করতে পন্টুন এলাকার ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
এদিকে পদ্মা নদীতে তীব্র ¯্রােত বইতে থাকায় নৌ-রুটে স্বাভাবিক ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌ-রুটের বহরে মোট ১৯টি ফেরি রয়েছে। এর মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে মাধবীলতা নামের একটি ইউটিলিটি ফেরি বিকল হয়ে পাটুরিয়ার ভাসমান কারখানা মধুমতিতে পড়ে আছে।
নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডে রয়েছে রো রো (বড়) ফেরি খানজাহান আলী। ইঞ্জিন দুর্বল হয়ে পড়ায় বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও হাসনাহেনা নামে অপর তিনটি ফেরি ¯্রােতের প্রতিকূলে চলাচল করতে পারছে না। তাই দুর্বল ওই তিনটি ফেরি পাটুরিয়া ঘাটে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে। বহরে থাকা ১৯টি ফেরির ৫টি বিকল থাকায় গুরুত্বপূর্ণ এ নৌ-রুটে ফেরিরও সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
বিআইডবিøউটিসি’র দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ফেরি ও ঘাট সঙ্কটের পাশাপাশি ঢাকাগামী গাড়ির চাপ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার দুপুরের পর থেকে দৌলতদিয়া ঘাটে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
যানজট পরিস্থিতি ও ৪ নম্বর ঘাট বন্ধ হওয়ার খবর পেয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে দৌলতদিয়া ঘাটে আসেন রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী, রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক জিনাত আরা, গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ ঘোষ, আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মÐল, নজরুল ইসলাম মÐল ও বিআইডবিøউটিএ’র কর্মকর্তারা।
জেলা প্রশাসক বলেন, বন্ধ ঘাট দু’টি চালু করতে সংশ্লিষ্টরা কাজ করে যাচ্ছেন। বিষয়টি আমরা মনিটরিং করছি। আশা করি, দ্রæতই সমস্যার সমাধান হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন