সবার কৌতূহল, আমাদের দেশে মানুষ কখন এলো। আমাদের জেলায় কখন এলো? আমাদের গ্রামে কখন এলো? কীভাবে এলো? কোন্ দিক থেকে এলো? যে পথ অতিক্রম করে এলো সে পথে আমাদের জন্য কী কী চিহ্ন রেখে এলো, আমরা কাদের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি?
নানা প্রসঙ্গে এসব কথা এসে যায় বলে আলতোভাবে অনেক কথা জানতাম বলে মনে করতাম। কিন্তু ডক্টর ইব্রাহীমের নতুন বই ‘শিকড়’ পড়ার পর প্রথম বুঝতে পারলাম কত কথাই আমার অজানা ছিল (শিকড়, মুহাম্মদ ইব্রাহীম, প্রকাশক অনন্যা)। এরকম বইয়ে কী কী ধরনের খবর আশা করা যেতে পারে, একটা ধারণা নিয়েই বইটি পড়া শুরু করেছিলাম। মোটেই বুঝতে পারিনি যে বইটি আমাকে একেবারে মাতিয়ে তুলবে। বইটি কিছুতেই হাত থেকে ছাড়তে পারছিলাম না। ছোটবেলায় রহস্য-উপন্যাস নিয়ে যেরকম মজে যেতাম, শিকড় পড়তে গিয়ে আবার সেই আমেজ ফিরে পেলাম। আগ্রহের এমন উত্তেজনা নিয়ে কোনো বই পড়েছি, এরকম কোনো ঘটনা গত বহু বছরের মধ্যে ঘটেছে বলে মনে আসছে না।
শিকড় পড়ার সময় মনে হয়নি, আমি কোনো গবেষণামূলক বই পড়ছি। সব সময় মনে হচ্ছিলো, আমি দীর্ঘ পথ ধরে আমার পারিবারিক পরিক্রমার কাহিনী পড়ছি। কাহিনী এমনভাবে জমে উঠতে শুরু করলো যে, এক পর্যায়ে উদ্বিগ্ন বোধ করতে আরম্ভ করলাম বইটির পাতা শেষ হয়ে আসছে না তো। অবশ্যই বইটি এক সময় শেষ হয়েছে, কিন্তু আমি তাকে শেষ হতে দিইনি, আবার পড়া শুরু করেছি। দ্বিতীয় বার পড়তে গিয়ে যেন আরো নতুন স্বাদ পেতে আরম্ভ করলাম।
মানুষের অভিবাসন নিয়ে লেখা বই পড়তে গিয়ে কারো চোখে পানি এসে যাবে এরকম কোনোদিন কল্পনা করিনি। কিন্তু এই বই পড়তে গিয়ে চোখের পানি ঠেকাতে পারিনি। লেখক কি শিকড় বইতে নতুন কোনো কথা বলেছেন? হয়তো বলেছেন, হয়তো বলেননি। কিন্তু আমার দিক থেকে নিশ্চিত করে বলতে পারি লেখক আমার ঔৎসুক্যের মাপে খাপে খাপে মিলিয়ে এমনভাবে লিখেছেন, যাতে এই বইতে গভীরভাবে মগ্ন হয়ে যেতে পারি; এর কোনো কথাই আমার কৌতূহলের গন্ডি ছাড়িয়ে যায়নি।
এটা একটা বিজ্ঞানভিত্তিক বই, এই বইতে যা আছে তত্ত¡গতভাবে তার সবকিছুই নানা ভাষার নানা গবেষণামূলক নিবন্ধে নানা ভাষ্যে নিশ্চয়ই গভীরভাবে আলোচিত হয়েছে। আপনার আমার অত ধৈর্য নেই যে, এত সব নিবন্ধের নানা মত-মতান্তর ঘেঁটে আমাদের ঔৎসুক্য মেটাবো। অতসব গবেষণাপত্রে আমরা নিশ্চয়ই হারিয়ে যেতাম। আমাদের আসল ঔৎসুক্যের স্থলটি খুঁজে পেতাম না। ‘শিকড়’ বইয়ের বড় অবদান হলো লেখক সবটা কাজ করে, তার সব স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে গল্পটি আমাদের সামনে তুলে দিয়েছেন। বইটি পড়ার সময় তাই বার বার ইচ্ছে করেছে লেখককে কীভাবে ধন্যবাদ দিই, এই কাজটির জন্য।
অন্য পাঠকদের কী মনে হবে জানি না, আমার ক্ষেত্রে প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় মনে হয়েছে নতুন কিছু শিখলাম। কিছু জিনিস আমার অজানা ছিল বলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে, আবার কিছু জিনিস বিচ্ছিন্নভাবে যেন জান্তাম, কিন্তু এইভাবে তো নয়। সব কিছু যেন সারিবদ্ধ হয়ে চমৎকার কাহিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
বইটি একটি গবেষণা গ্রন্থ, এতে এমন কিছু নেই যাকে বৈজ্ঞানিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়নি; তথ্যের দিক থেকে এ এক ঠাস্-বুনোট বই। অথচ, লেখক একে পরিবেশন করেছেন ভ্রমণ কাহিনীর সাবলীলতা দিয়ে, যা তর তর করে পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই বলে সহজবোধ্য করার জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা ইতিহাসের যুক্তি-তর্ককে মুচড়িয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার কোনো প্রবণতা এতে নেই। ইতিহাসের সর্বাধুনিক উপাদান হিসেবে ডিএনএ’র ব্যবহারও কী চমৎকারভাবে করা হয়েছে তার তত্ত¡টিকে পর্যন্ত তিনি সহজ ভাষায় তুলে ধরতে কার্পণ্য করেননি।
বাংলাদেশ বরাবর একটি জঙ্গলে ভরা জলাভ‚মি ছিল। এই জঙ্গলেও লোক এসেছিলো। কখন কোন্ দিক থেকে তারা এসেছিল- পশ্চিম, না পূর্ব, না দক্ষিণ দিক থেকে, এসব প্রশ্ন আমাদের মনে। সুদূর আন্দামানের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা আছে জেনে খুব অবাক হলাম। আন্দামানকে কালাপানির দেশ হিসেবে জানতাম, যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তদের পাঠিয়ে দেবার জায়গা হিসেবে জানতাম। কিন্তু জানতাম না যে, আন্দামান আমাদের পূর্বপুরুষের যাত্রাপথের সঙ্গী হয়ে আমাদেরকে আরেক বিশাল জগতের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিলো। তখন ইন্দোনেশিয়া হয়ে সুদূর অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত যারা গিয়েছিলো তাদের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক দেখিয়ে দেয়া মানুষগুলো এখনো আন্দামানে রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মহাপরিবর্তনের সূচনা করেছিল ভল্গা তীরের পশুপালকরা। তারা তাদের পালিত পশুর ও নিজেদের খাদ্য প্রাপ্তি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো চার হাজার বছর আগে। খাদ্যের সুরাহা করার জন্য পশুপাল আর ঘোড়ায় টানা ওয়াগন গাড়ি নিয়ে তারা অভিবাসী হয়েছিলো ইউরোপে, ইরানে, ভারতে। এক দিনে নয়, ক্রমাগত একের পর এক দলে। ভারতবর্ষে যারা এলো স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন ভাষা, নতুন সাহিত্য, নতুন ধর্ম, নতুন সভ্যতা সৃষ্টি করলো।
ছোটবেলায় স্কুলে ইতিহাসের বইতে দেখতাম অশোক স্তম্ভের ছবি। মোটেই আকর্ষণীয় মনে হয়নি। ভাঙ্গা একটি স্তম্ভ, এতে দেখার কী আছে? অনেক দিন পর শিকড় পড়ে বুঝলাম, কত বড় মহান কাজ ছিল এটি। সম্রাট অশোক চেয়েছিলেন ধর্ম-সংঘের কথা নিয়ে তাঁর বাণী সকল প্রজার কাছে পৌঁছে দিতে, আর তাকে স্থায়ী করতে। কিন্তু ভারতে তখনো সব ভাষা শুধু মুখে মুখে, এমনকি পবিত্র ভাষা সংস্কৃতও। লিপি যদি থেকেও থাকতো খুব কম মানুষই তার কথা জানতো। অশোক এক অদ্ভুত প্রকল্পের মাধ্যমে কাজটি করবেন বলে ঠিক করলেন। ভারতে তখন জনপ্রিয় যে মুখের ভাষাগুলো সেগুলোই তিনি পাথরে উৎকীর্ণ করলেন এক নতুন লিপিতে; সাম্রাজ্যের অসংখ্য জায়গাতে, একেবারে দূরের নানা সীমান্তে। এটিই বোধ হয় কোনো সম্রাটের পক্ষে প্রথম একটি সর্বভারতীয় প্রকল্প। সেই নতুন লিপি ব্রাহ্মী এরপর বাংলাসহ সব ভারতীয় লিপিরই শুধু নয়, এশিয়ার আরো বহু লিপির প্রথম রূপ হলো। কত বড় প্রকল্প! আজকের দিনে এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে কতো কারিগর, লোকজন, আমলা এবং খরচ লাগবে তা নিয়ে ভাবতেই মাথা ঘুরে যায়। আরো মজার ব্যাপার হলো, এত কিছুর মাধ্যমে সম্রাট কোনো ফরমান জারী করছেন না, অত্যন্ত বিনীত ভাষায় ব্যক্তিগতভাবে প্রজাদের কাছে সরাসরি বলছেন, মনের শান্তির জন্য ধর্মের কাজ করতে- তিনি এতে শান্তি পেয়েছেন, সবাই যেন পায়। ভাবতে অবাক লাগে, এটি তেইশ শত বছর আগের কথা।
এই বইয়ের কারণে চট্টগ্রামসহ সমগ্র স্থলভাগকে সমুদ্রের দিকে থেকে দেখার সুযোগ হলো। পর্তুগীজ বণিকদের আনাগোনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বন্দর সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো, তার সঙ্গে আকর্ষণীয় হলো কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপগুলোও। পর্তুগীজরা একদিকে বণিক, অন্য দিকে হার্মাদ জলদস্যু হিসেবে এই পুরো উপক‚লীয় অঞ্চল থেকে মানুষ ধরে নিয়ে দূর দূর দেশে দাস-ব্যবসার কেন্দ্রগুলোতে বিক্রি করছে- সে এক কালো অধ্যায়।
চট্টগ্রামের ইতিহাস আবার নতুন আঙ্গিকে খুঁজে পেলাম। তাতে স›দ্বীপ যে এতো বড় ভূমিকা রেখেছে, জানতাম না। পর্তুগীজ আর আরাকানীদের মোকাবেলার জন্য মোগল সম্রাটকে নৌবহর গড়ে তুলতে হয়েছিলো, সন্দ্বীপ ছিল সংঘাতের একেবারে সামনের জায়গা। কিন্তু তার আগেই পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম বন্দরে কায়েম হয়ে বসেছিলো ও ইউরোপ থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত তাদের ‘ভারত যাত্রার’ নিয়মিত বন্দর চট্টগ্রাম। প্রথমে পর্তুগীজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সবার জাহাজ ভেড়ে এখানে।
চট্টগ্রামের মানুষের এভাবেই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে জাহাজের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নোয়াখালী আর সিলেটের মানুষেরাও। পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রে তখন তাদের সগর্ব উপস্থিতি; জাহাজি অভিজ্ঞতা, জাহাজি সংস্কৃতি, জাহাজি ভাষা এ অঞ্চলের মানুষকে সমৃদ্ধ করলো।
এই বই থেকে জানলাম, পালতোলা জাহাজের পরিচালনায় আমাদের এই নাবিকদের কী বিরাট ভূমিকা। তার সঙ্গে জানলাম, শুধু বাতাসকে ভর করে জাহাজ কীভাবে দুনিয়ার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় চলে যেতে পারে, সব রকম আবহাওয়ায় এমনকি প্রচন্ড সমুদ্র-ঝড়কে মাথায় নিয়ে। বরাবর কৌতূহল ছিল, পালতোলা জাহাজ বাতাসের বিপরীতেও কেমন করে সমুদ্র পাড়ি দিত? এই বই বিস্তারিতভাবে সে প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছে। এখন পালতোলা জাহাজের ছবি দেখলে খেয়াল করে দেখি, জাহাজটি কী ধরনের পাল তুলেছে। এটি কি বাতাসের অনুকূলে যাচ্ছে, নাকি প্রতিক‚লে? পালের যে রকমফের আছে, তা এই বই পড়ার আগে জানিনি।
পৃথিবীর ভাষা-পরিবারের বহুতরো পরিমন্ডলে চট্টগ্রামের ভাষাকে ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষা পরিবারের একটি উল্লেখযোগ্য ভাষা হিসেবে দেখলাম। দুনিয়ার সব ভাষাই তো মানুষের কথোপকথনের মধ্য দিয়েই নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষাও ওভাবেই সৃষ্ট একটি ভাষা। কোনোটি ভাষা, কোনোটি উপভাষা পর্যায়ে থেকে যায়ও নানা কারণে কোনোটি গুরুত্ব পেয়ে প্রমিত হয়, লিখিত হয়, সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না চট্টগ্রামের ভাষা বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে, সামনে কোনো দিন এ ভাষায় আলাপ করার কোনো লোকই হয়তো অবশিষ্ট থাকবে না। শিশুর প্রথম কথা বলা শুরু করার সময় থেকে বাবা-মা’রা তার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন সেটিই প্রজন্মান্তরে যুগ যুগ ধরে বিস্তৃত হয়। চট্টগ্রামের অনেক পরিবার শিশুর সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করেন না। ওভাবে এ ভাষা হারিয়ে যেতে দেরি হবে না। চট্টগ্রামের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাঝে মাঝে কিছু প্রচেষ্টা দেখা গেছে, কিন্তু তা বড় উদ্যোগে পরিণত হয়নি। আরাকানের সঙ্গে বহুকাল একাকার থাকার কারণে চট্টগ্রামের ভাষার বিস্তৃতি আরাকান পর্যন্ত ছিল। তাই এটি ওখানকার রোহিঙ্গাদেরও ভাষা। চট্টগ্রামের ভাষার ভবিষ্যৎ তাদের উপরও বর্তায়।
উপরে খাপছাড়াভাবে কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করলাম। ‘শিকড়ের’ পাতায় পাতায় এরকম অনেক বিষয়ে নানা কথা এসেছে। বইটি পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর এটা অবশ্যই পড়া দরকার। এই বইটা আমাদের অতীতকে সহজভাবে এবং সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। আমরা যারা এখন ছাত্র নই তাদেরও এই বই পড়া দরকার, আগে যা পড়েছি তা নতুনভাবে আবার বোঝার জন্য।
ডক্টর ইব্রাহীমকে ধন্যবাদ এই বই লেখার জন্য, আমার মতো অনেককে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়ার জন্য। প্রত্যেকে নিজে পড়লে এবং ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনীদেরকে পড়তে উৎসাহিত করলে এবং তাদের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করলে, সবাই উপকৃত হবেন এবং আনন্দ পাবেন বলে মনে করি।
লেখক: নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন