সিডর, আইলা, আমফানের মত প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আবারও বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ উপক‚লজুড়ে ‘যশ’ আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আশঙ্কা করা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি আগামীকাল অথবা বুধবার উপক‚লে আঘাত হানতে পারে। এ খবরে কয়েক লাখ মানুষ এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। হাজার হাজার মৎস্য ঘের ও ফসলি জমির মালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মজুদ করা হয়েছে শুকনো খাবারের। গঠন করা হয়েছে মেডিকেল টিম। বন্দরে জারি করা হয়েছে সতর্কতা সংকেত।
সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডর এ অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ভেঙে তছনছ করে দেয়। সিডরের ক্ষতি যখন মানুষ কিছুটা কাটিয়ে উঠছিল তখন ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানে আরেকটি প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় আইলা। এর মাঝে ছোট বড় কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের পর ২০২০ সালের ২০ মে বড় আঘাত হানে আম্ফান। পরপর এতগুলো আঘাত বুক পেতে বাধা দিতে গিয়ে প্রকৃতির ঢাল খ্যাত সুন্দরবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপক‚লের কয়েকশ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এখনো উপকূলীয় নদনদীতে জোয়ারের পানি সামান্য বৃদ্ধি পেলে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা, ভেঙ্গে যায় বাঁধা। ঘূর্ণিঝড়গুলোর সাথে জলোচ্ছাস এবং অতিবৃষ্টির কারণে শত শত মৎস্যঘের ও ফসলী জমি তলিয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহ হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। এসকল কারণে পুরো উপক‚লীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থায় দেড় যুগ ধরে ধ্বস বিরাজ করছে।
আবহাওয়া বিভাগের গতকাল দুপুরের বুলেটিনে নিম্নচাপটি দুপুর ১২টায় পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৬৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থানের কথা জানিয়েছে। ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সঙ্কেত বহাল রাখতে বলা হলেও দেশের কোন অভ্যন্তরীণ নদী বন্দরকে সঙ্কেতের আওতায় আনা হয়নি। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রস্তুতি শুরু করেছেন। বন্দরের সবগুলো নৌযান সঠিক অবস্থানে নোঙর করাসহ নোঙরের স্থান প্রস্তুত করে সে লক্ষে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, যশকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বরিশালে উপকূলের ১৩টি জেলার ৪১টি উপজেলায় রেড ক্রিসেন্টের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) প্রায় ৭৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্বল্পতম সময়ে উপক‚লের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রসহ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনতে এসব স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে বলে সিপিপি’র দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া আবহাওয়া বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সরকারি নির্দেশনার আলোকে দ্রুততম সময়ে উপকূলে ঝড়ের সতর্কতা পৌছে দিতেও প্রস্তত রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। খুলনায় এ পর্যন্ত ৩৪৯ টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত হয়েছে, ১১৪ টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ৩৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। গত বছর ৮১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছিল; এবার আরও বেশি সংখ্যক প্রস্তুত করা হবে। কোভিড-১৯ এর কারণে সংক্রমণ রোধে আশ্রয়কেন্দ্রের সক্ষমতার অর্ধেক মানুষকে একটি কেন্দ্রে রাখা হবে। একইসঙ্গে প্রতিটি উপজেলায় পাঁচটি ও প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে মোট ১১৪টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত করা হয়েছে। যারা চিকিৎসা সেবা দেবেন। এ ছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনো খাবার, অর্থ, চাল-ডাল প্রস্তুত রয়েছে। সরকারি নিদের্শনা মোতাবেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। আতঙ্ক নয়, উপকূলবাসীকে সজাগ ও সতর্কতার মাধ্যমে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য আহবান জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, শুক্রবার জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৪৪ আশ্রয়কেন্দ্র। প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়টি মোকাবিলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট, নৌবাহিনী কোস্টগার্ডসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জনগণকে ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার, দিয়াশলাই ও ঝড়ের সময় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আ ন ম ফয়জুল হক। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় গতকাল তিনি এ আহবান জানান। বাগেরহাট জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জানানো হয়, বাগেরহাট উপক‚লীয় জেলা হওয়ায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এ জেলার মানুষ একটু বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাই ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার ফকর উদ্দিন জানান, আবহাওয়া অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দর সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। নৌযান চলাচলে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলায় সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় ১৪৫টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে দেড় হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা। ১৮৪ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। পর্যাপ্ত পানীর ব্যবস্থা রয়েছে। একই সঙ্গে নগদ দুই কোটি ১৫ লাখ টাকাও হাতে রয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শুক্রবার দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এ তথ্য জানানো হয়। ঘূর্ণিঝড় সাতক্ষীরা উপক‚লে আঘাত হানতে পারে- এমন আশঙ্কা মাথায় রেখে এসব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, দেবহাটাসহ অন্যান্য উপজেলার বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয়েছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ জানান, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘূর্ণিঝড় বেশি শক্তিতে আঘাত হানতে পারে। এখনও নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না ঘূর্ণিঝড়টি কোন কোন এলাকায় আঘাত হানতে পারে। তবে সুন্দরবনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। আবার দিক পরিবর্তনও হতে পারে। এ অবস্থায় বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সমগ্র খুলনাঞ্চলের তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন