বাংলাদেশে বায়ু দূষণ বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বায়ু দূষণের কারণে এক বছরে (২০১৩ সাল) বাংলাদেশে এক লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৯০ সালে বায়ু দূষণে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার। সেই হিসাবে ২৬ বছরে বায়ু দূষণে মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুতে সবচেয়ে ক্ষতিকর সাসপেন্ডেন্ড পার্টিকুলেট ম্যাটার বা ভাসমান বস্তুকণার মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এক লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৮ জনের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষেরই মৃত্যু হয়েছে ভাসমান বস্তুকণার কারণে। প্রতিবেদন মতে, দ্রুত শিল্পায়ন, নির্মাণ শিল্পের বিকাশ, কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং যানবাহনের সংখ্যাধিক্যের ফলে বায়ুতে দূষণের মাত্রা বাড়াছে। রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প এলাকা থেকে ক্রমাগত হাইড্রোজেন, সালফার ডাই-অক্সাইড ও অ্যামোনিয়াসহ বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হচ্ছে। শিল্প-কারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং ইটভাটা, চিনিকল, সার-কারখানা, পাটকল, বস্ত্র ও পোশাক কারখানা থেকেও অবিরাম বায়ু দূষণ হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ অ্যাজমা বা হাঁপানিতে আক্রান্ত। এর জন্য প্রধানত বায়ুতে ভাসমান বস্তুকণাই দায়ী। ফুসফুসের ক্যান্সারেরও অন্যতম কারণ বায়ু দূষণ।
বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর এত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প, নির্মাণ, কৃষি প্রভৃতির প্রসার ও বিকাশ অত্যাবশ্যক। শিল্প-কলকারখানা স্থাপন যেমন বন্ধ করা যাবে না তেমনি যানবাহনের সংখ্যাও কমিয়ে ফেলা যাবে না। আবার এসবের কারণে বায়ু দূষণ হবে এবং তার বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হবে। এ ক্ষেত্রে করণীয় হতে পারে, বায়ু দূষণের মাত্রা কমানোর ব্যবস্থা করা। বৃক্ষরোপণসহ বায়ু দূষণ প্রতিশেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শিল্প-কারখানা নির্দিষ্ট এলাকায় পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ বা স্থানান্তর করে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণরোধক ব্যবস্থা নেয়া হলে সব ক্ষেত্রেই দূষণের মাত্রা কমতে পারে। যানবাহন ও জ্বালানির মান বজায় রেখে বায়ু দূষণ কমানো সম্ভব। সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থাও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল দিতে পারে। ইটভাটার মাধ্যমে বায়ুতে বড় ধরনের দূষণ ঘটছে। ইটভাটা লোকালয় থেকে বহু দূর স্থাপন এবং নির্মাণকাজে পোড়া ইটের বিকল্পের ব্যবহার বাড়ানো গেলে বায়ু দূষণের মাত্রা হ্রাস পেতে পারে। ব্যাপক বৃক্ষরোপণ বা বৃক্ষায়ন বায়ু দূষণ রোধ ও বায়ুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ কারণে শহরে-গ্রামে, শিল্প এলাকায় যত বেশি সম্ভব বৃক্ষরোপণ করা যেতে পারে।
এটা বিশেষভাবে বিবৃত করার অপেক্ষা রাখে না যে, বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার রাজধানীসহ বড় শহরগুলো। রাজধানী দেশের সবচেয়ে বড় আবাসিক এলাকা। একই সঙ্গে এখানে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় শিল্প কারখানা। যানবাহন চলাচলও এখানে সবচেয়ে বেশি। এমতাবস্থায়, সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণ এখানে ঘটছে এবং বায়ু দূষণজনিত প্রাণহানির সংখ্যাও এখানেই বেশি। হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প কেবল বায়ু দূষণই ঘটাচ্ছে না, পাশাপাশি পানিসহ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে মারাত্মকভাবে দূষণের শিকারে পরিণত করছে। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলেও বছরের পর বছর তা ঝুলে আছে। অন্যান্য শিল্পকারখানাও বায়ু দূষণ করছে যদিও এরকম সিদ্ধান্ত হয়ে আছে যে, ক্রমান্বয়ে সব শিল্পকারখানাই বাইরে স্থানান্তর করা হবে। এরও কোনো অগ্রগতি নেই। বায়ু ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমাতে রাজধানীতে সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার তাকিদ বারবার উচ্চারিত হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। এই পটপ্রেক্ষাতেই দুই সিটি করপোরেশন গ্রিন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা করার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে বায়ু দূষণ হ্রাস, তাপমাত্রা হ্রাস, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, সবুজায়ন ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। উদ্যোগগুলো ইতিবাচক। তবে তা কতদূর ও কবে নাগাদ বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটাই প্রশ্ন। রাজধানীকে পরিবেশবান্ধব ও বসবাসের উপযুক্ত স্থানে পরিণত করতে হলে শিল্প-কারখানা যতদ্রুত সম্ভব সরিয়ে দিতে হবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। চার পাশের নদীগুলো দূষণমুক্ত, পরিচ্ছন্ন ও নাব্য করতে হবে। পরিবহন ব্যবস্থাপনায়ও আনতে হবে পরিবর্তন। এরই পাশাপাশি সবুজায়নের উদ্যোগ সফল করে তুলতে হবে। সবুজায়নের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য বড় শহরেও একই কর্মসূচি বা উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু শহরে নয়, সারাদেশেই বনায়ন ও বৃক্ষায়নের ওপর জোর দিতে হবে। আশা করা যায়, এতে বায়ু, পানি, মাটি ও পরিবেশের অন্যান্য উপাদানে দূষণের মাত্রা হ্রাস পাবে এবং দেশ ফের পরিবেশবান্ধব, মানববান্ধব দেশ হয়ে উঠবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন