শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

গ্লোব-বায়োটেকের টিকার খবর কী?

জহির চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০২১, ১২:০৩ এএম

বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড গত বছর অক্টোবরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অবহিত করে, তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধক টিকা ‘ব্যানকোভিড’ (বর্তমান নাম ‘বঙ্গভ্যাক্স’) অ্যানিমেল ট্রায়ালে নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা মেডিক্যাল জার্নাল বায়োআর্কাইভ গত বছর অক্টোবরে জানিয়েছে, গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকা করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম। একই সময়ে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত তিনটি টিকার নাম তার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। তালিকায় গ্লোব বায়োটেকের অবস্থান ছিল ২০ নম্বরে। এ অবস্থান অক্সফোর্ড এবং মর্ডানারও উপরে। গ্লোব বায়োটেকের অতি অল্প সময়ে টিকা উদ্ভাবন প্রশংসা লাভ করে।

যেকোনো নবোদ্ভাবিত ওষুধ/প্রতিষেধক মানবদেহে প্রয়োগের আগে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এ পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা হয় ধাপে ধাপে। এর কার্যকারিতা এবং পাশর্^প্রতিক্রিয়ার মাত্রা বুঝার জন্য। গ্লোব বায়োটেক তার উদ্ভাবিত টিকার গুণাগুণ, কার্যকারিতা, পাশর্^প্রতিক্রিয়ার মাত্রা দেখার জন্য অ্যানিমেল ট্রায়ালসহ আরো কিছু অত্যাবশ্যকীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে কমবেশি চার মাস আগে। সরকারের কাছ থেকে এ ট্রায়ালের অনুমতি এখনো মেলেনি; অনুমতি কবে মিলবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অন্যান্য দেশ তাদের উদ্ভাবিত করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধক টিকার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন করে ব্যবহারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ নিজের উদ্ভাবিত টিকার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্নে সময়ক্ষেপণ করছে। সময়ক্ষেপণ যে অদূরদর্শীতার পরিচায়ক হচ্ছে, সেকথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। সময়ক্ষেপণের কারণে বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠছে প্রায়ই। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম গোলাম কাদের এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘দেশের মানুষ জানতে চায়, কার স্বার্থে চার মাস অতিবাহিত হলেও বঙ্গভ্যাক্সের ট্রায়াল হচ্ছে না। করোনা প্রতিরোধে বিদেশি টিকা আমদানির পাশাপাশি দেশে তৈরি টিকা বঙ্গভ্যাক্সের সফলতার জন্য সরকারিভাবে সহায়তা দিতে হবে।’ দেশে উদ্ভাবিত টিকার ট্রায়ালের অনুমতি চার মাসেও না মেলায় এ ধরনের প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এর আগে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিট পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে, দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও শেষতক ব্যবহারের অনুমোদন মেলেনি। দেশে উদ্ভাবিত করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধক টিকা, করোনা শনাক্তকরণ কিট ব্যবহার করা গেলে করোনার ধকল মোকাবেলা অনেকটাই সহজ হতো। করোনার টিকা ও করোনা শনাক্তকরণ কিটের জন্য এতোটা বিদেশ নির্ভর হতে হতো না। দেশে উদ্ভাবিত টিকা ও কিট দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করা যেত। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পেত, বিপুল অর্থ আয়ও সম্ভব হতো। করোনার কারণে দেশের রফতানি বাণিজ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে তার বহুগুণ আসতো করোনা টিকা ও কিট রফতানির মাধ্যমে। দেশীয় উদ্ভাবন সবদেশেই সর্বোচ্চ সহযোগিতা পায়। এ দেশেই ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশীয় বহু উদ্ভাবন পৃষ্ঠপোষকতা-সহযোগিতার অভাবে কাজে লাগানো যায়নি।

করোনার টিকা উদ্ভাবনে সফল হয়েছে এমন দেশের সংখ্যা হাতে গোনা। টিকা উদ্ভাবক দেশগুলো করোনা প্রতিরোধক টিকাকে অর্থ কামাই এবং রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের মোক্ষম অস্ত্র বানিয়েছে। বলা যায়, এটিও এখন মনোপলি ব্যবসা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পণ্য। করোনা টিকা সংগ্রহ করতে গিয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থা হয়েছে, তাকে নাকানি-চুবানি খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। বাংলাদেশ অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেও করোনারে টিকা পাচ্ছে না, টিকার জন্য বিভিন্ন দেশের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিতে হচ্ছে। নিজের উদ্ভাবিত টিকার প্রতি অনাগ্রহ দেখানো মস্ত বড় ভুল যে হচ্ছে তা, বাইর থেকে টিকা সংগ্রহের তিক্ত অভিজ্ঞতাই বলছে। গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকার কার্যকারিতা বিদেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ‘ভ্যাকসিন‘-এ বঙ্গভ্যাক্স নিয়ে করা গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে সম্প্রতি। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক আবিষ্কৃত করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের টিকার এক ডোজই সুরক্ষা দিতে সক্ষম। বঙ্গভ্যাক্স এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি বিশে^র প্রথম কার্যকর টিকা, যা সার্স-কোভ-২ (নভেল করোনা) ভাইরাসের বিরুদ্ধে সফলভাবে মানব কোষ এবং প্রাণীদেহে সুদৃঢ় সুরক্ষা দেখিয়েছে। বঙ্গভ্যাক্স নিজ দেশে অবহেলিত হলেও বিদেশে মূল্যায়িত হচ্ছে। করোনার টিকা উদ্ভাবনের সুফল দেশ ও দেশের মানুষ তকদিরে আছে কিনা তা নিয়েও সন্দিহান থাকতে হচ্ছে। বঙ্গভ্যাক্স এভাবে অবহেলিত হতে থাকলে এক পর্যায়ে এর আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের কাছ থেকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কেউ না কেউ প্রযুক্তি কিনে নিয়ে অথবা গ্লোব বায়োটেকের সাথে যৌথভাবে অন্য কোনো দেশে তৈরির উদ্যোগ নিতে পারে। তাই দেশে উদ্ভাবিত টিকার মানবদেহে ট্রায়ালের অনুমতি প্রদানে কালক্ষেপণ কোনো বিচারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
লেখক: সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন