এ সপ্তাহে উপকুলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণীঝড় ইয়াস। বাংলাদেশে এর তীব্রতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের চেয়ে অনেক কম হলেও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক বেশি। সমুদ্রোপকুলীয় সমভূমি হওয়ার কারণে হাজার বছর ধরে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি আকষ্মিক ভয়াবহ উপকূলীয় ঘূর্ণীঝড়ের তান্ডবে লাখো মানুষের প্রাণহানি ও লাখ লাখ টন ফসলহানি এবং কোটি কোটি মানুষকে বারংবার অশেষ দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এখন সেটেলাইটভিত্তিক উন্নত আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবস্থা থাকা এবং উপকুলীয় এলাকায় ঘূণীঝড় আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে মানুষের প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও বাঁধ ভেঙ্গে ব্যাপক ফসলহানি এবং পানিবদ্ধতার জনদুর্ভোগ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। প্রতিবছর উপকুলীয় বাঁধ নির্মান ও বাঁধ সংস্কারে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও এসব খরচ তেমন কোনো কাজে আসছে না। যেন কেন প্রকারে বাঁধ নির্মান ও সংস্কারের পিছনে ব্যয়িত অর্থ বড় ধরনের অপচয় হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। যেখানে ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বেড়িবাধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো এখনো টিকে আছে, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচে নির্মিত নতুন বাঁধগুলো বছর না ঘুরতেই বর্ষার পানির ধাক্কায় ভেঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকে সামনে রেখে তড়িগড়ি করে বাঁধ নির্মান ও বাঁধের সংস্কার কাজের মান কখনোই রক্ষিত হয়না। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা উপকুলীয় ভূমি রক্ষা বাঁধ একটি দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। বাধ নির্মান ও সংস্কারের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের মানদন্ড রক্ষিত না হওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এসব ক্ষতির স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে হলে বাঁধ নির্মান ও সংস্কারে দুর্নীতি, অপচয় ও অস্বচ্ছতা দূর করতে হবে। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, করোনাভাইরাস অতিমারিতে অর্থসংকটের কারণে দেশের ৩৫৬টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে উপকূলীয় বাঁধ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো রক্ষায় আরো বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
ঘূর্ণীঝড় ইয়াস দেশের দক্ষিণ পশ্চিমের জেলাগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসের থাবা বসিয়ে গেছে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ কক্সবাজার, বাগেরহাট, সুন্দরবন, সাতক্ষিরায় হাজার হাজার বাড়িঘর, হাজার হাজার একর ফসলের মাঠ,শত শত মাছের ঘের, শত কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও উপকুলীয় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কোটি মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাতক্ষিরার শ্যামনগরে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধ নির্মানের দাবিতে কাফনের কাপড় পরে বাঁধের উপর বিক্ষোভ সমাবেশ করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ত্রাণ সহায়তা চাননা, টেকসই বাঁধ নির্মান করে দুর্ভোগের কবল থেকে মুক্তি চায়। সেই আইলা ও সিডর থেকে শুরু করে ঘুর্ণীঝড় ফণি ও আম্ফান পর্যন্ত গত একযুগে দেশের উপকুলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানা প্রতিটি দুর্যোগে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত রেখে গেছে। সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ ও পানিবদ্ধতার সমস্যা থেকে কোনো কোনো এলাকার মানুষ এখনো পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি আম্ফানের ক্ষতির দ্বিগুণ বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। ইয়াসের জলোচ্ছাসে বাঁধ ভেঙ্গে ফসল হানি ও ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার পর উপকুলীয় জনপদের লাখ লাখ মানুষ সুপেয় পানির উৎসগুলোও হারিয়েছে। সেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকটে দিনাতিপাত করছেন সাধারণ মানুষ। সে সব দুর্ভোগের আহাজারি ছাপিয়ে বাঁধ-বেড়িবাঁধ নির্মানে টেকসই ও স্থায়ী ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পক্ষে তাদের সম্মিলিত কন্ঠ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার।
ঘুর্ণীঝড় ইয়াসের জলোচ্ছাসে ঘরবাড়ি ও আশ্রয় হারানো মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে জরুরি পুনর্বাসন ও ত্রাণসহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে দুর্যোগ উত্তর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও টেকসই উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নে গতানুগতিক পন্থা পরিহার করে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঘূর্ণীঝড়ে দেশে কি পরিমান আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো হাতেই নেই। ইউএনডিপির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে উপকুলীয় ঘুর্ণীঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ১৬বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের আরেক রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০০০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আর্থিক ক্ষতির পরিমান ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বন্যা ও ঘুর্ণীঝড়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩২০ কোটি ডলারের (প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা)ক্ষতি হয়, যা দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২.২ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্মুখ সারির ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চলতি শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে এই ক্ষতির পরিমান কমপক্ষে তিনগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। টেকসই ও স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ঘুর্ণীঝড় ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। যেনতেন প্রকারে অস্থায়ী ভিত্তিক বাঁধ নির্মান করে জনগণের রাজস্যের টাকার অপচয় ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। উপকুলীয় ভূমি এবং নদীগর্ভে ফসলি জমি ও জনপদ তলিয়ে যাওয়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষতি নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পানিসম্পদ উন্নয়ন ও উপকূলীয় সম্পদ রক্ষায় বহুমুখী টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন