শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলা

প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেড সদর দফতরে সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ জন সৈন্য নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার পাশে উরিতে অবস্থিত ওই ব্রিগেড সদর দফতরে রোববার ভোরে চার সন্ত্রাসী হামলা চালায়। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী সেনা-সন্ত্রাসী লড়াইয়ে চার সন্ত্রাসীও নিহত হয়। খবরে বলা হয়েছে, দেড় দশকের মধ্যে এটা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি হামলাকে ভয়াবহ বলে অভিহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এই কাপুরুষোচিত ঘটনার জন্য যারা দায়ী তারা উপযুক্ত শাস্তি পাবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফে এ হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীদের কাছে পাকিস্তানি অস্ত্র ও সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। পাকিস্তান ভারতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং প্রমাণ পেশ করার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। সন্ত্রাসী এই হামলা যে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং উদ্বেগজনক, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতোমধ্যে ভারত যেভাবে অভিযোগের আঙুল পাকিস্তানের দিকে তুলেছে এবং পাকিস্তান যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে পাল্টাপাল্টিটা জোরদার হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে হামলার মূল কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়তে পারে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, গত তিন মাস ধরে কাশ্মীরে যে দমন-পীড়ন চলছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও মিলিশিয়া বাহিনী যেভাবে পাখির মতো মানুষকে গুলি করে মারছে, নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে, এ হামলা তার একটি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতা বুরহান ওয়ালীর হত্যাকা-ের পর প্রতিবাদ বিক্ষোভে কাশ্মীরের জনগণ যেভাবে ফেটে পড়েছে, তা অভূতপূর্ব। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ একনাগাড়ে চলছে। অন্যদিকে দীর্ঘ কারফিউ বলবৎ রাখাসহ ভারতীয় সেনা-পুলিশ ও মিলিশিয়া বাহিনী তাদের অভিযান হত্যা, ধরপাকড় অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে সেখানে সেনা সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি গুলিতে নিহত এক কিশোরের নামাজে জানাজাকে কেন্দ্র করেও ভারতীয় বাহিনী চ-নীতি অনুসরণ করেছে। এ পর্যন্ত গুলিতে শতাধিক কাশ্মিরী নিহত হয়েছে, আহত যে কত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ভারতীয় সেনাবাহিনী ইসরাইল থেকে আনা এমন এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে যাতে অন্তত ৫০ জন তরুণ অন্ধ হয়ে গেছে। ভারতীয় সাংবাদিকদের কেউ কেউ কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতির তুলনা করেছেন। অনেকে ফিলিস্তিনের চেয়েও কাশ্মীরের পরিস্থিতি নাজুক ও ভয়াবহ বলে মনে করেন।
কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি অতীতের ধারাবাহিকতা মাত্র। কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ-সংঘাত শুরু হয়েছে সেই ’৪৭ সাল থেকে। ’৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের অমুসলিম শাসক হরিসিং লর্ট মাউন্টব্যাটেন ও নেহেরুর সঙ্গে যোগসাজশ করে ভারতে যোগদান করেন। এর অধিবাসীরা অধিকাংশ মুসলমান হওয়ায় পাকিস্তানে যোগদানে আগ্রহী ছিল। সেই থেকে বিরোধের শুরু। এ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দু’দুটি যুদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো ফয়সালা হয়নি। কাশ্মীরের একাংশ রয়েছে পাকিস্তানে যাকে আজাদ কাশ্মীর বলা হয়, বৃহদাংশ জম্মু ও কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে ভারতের নিয়ন্ত্রণ। এই বিরোধ মীমাংসায় ভারত জাতিসংঘে গেলে জাতিসংঘ গণভোটের প্রস্তাব দেয়। ভারত আজ পর্যন্ত সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি। যদি গণভোট হতো তাহলে অনেক আগেই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। পরবর্তীতে কাশ্মীরি নেতারা ভারতের সঙ্গে থাকতে সমঝোতার চেষ্টা কম করেননি। তাদের দাবি ছিল, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগÑ এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় ভারত সরকারের হাতে রেখে জম্মু ও কাশ্মীরের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন প্রদান বা স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষার সুযোগ দান। এটা মানা হয়নি। উপরন্তু ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার যে কথা আছে, বিজেপি সরকার তা বাতিল করার ব্যাপারে সোচ্চার। স্মরণ করা যেতে পারে, ভারত শুরু থেকেই সামরিক শক্তি বলে কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্য। বিলোপ ও ভারতভুক্তির চেষ্টা করে আসছে। ভারতীয় সেনা-পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী বিগত ৬৯ বছর ধরে কাশ্মীরে যে হত্যা-নির্যাতন ও দমন-পীড়ন চালিয়েছে তার কোনো দ্বিতীয় নজির নেই। নির্বিচারে হত্যা, অপহরণ, গুম ধর্ষণ, পীড়ন, উচ্ছেদ চালিয়েছে। জানা যায়, ’৪৭ সালেই দু’লাখ কাশ্মীরিকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীকাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৬০ লাখ কাশ্মীরি নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মার্কিন তথ্য মতে, ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। আহত অসংখ্য। ধর্ষণও বেসুমার। একটি জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এমন কিছু নেই যা ভারত করেনি।
ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে, ভারতের অব্যাহত হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও ক্লিনজিংয়ের প্রতিক্রিয়া হিসাবেই কাশ্মীরে নজিরবিহীন গণউৎক্ষেপ ঘটেছে। সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে, অত্যাচার-নির্যাতন বাড়িয়েও আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কাশ্মীর জনগণ মৃত্যুর ভয় না করে কারফিউ লংঘন করছে, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ইট-পাটকেল দিয়ে লড়ছে। এমতাবস্থায় সন্ত্রাস যত নিন্দনীয় হোক, রোখা কঠিন। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির নিরসন ঘটাতে হলে ভারতকে সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে। এখনকার অবস্থা এমন, কাশ্মীরকে ভারতের ভূগোলের মধ্যে রেখে সমাধান প্রায় সম্ভব। দু’তিন বছর আগেও কাশ্মীরি নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের যে সুযোগ ছিল এখন অনেকটাই তা হাতছাড়া হয়ে গেছে। কুলদীপ নায়ারও সে কথা স্বীকার করেছেন। নতুন প্রজন্মের কাশ্মীরিরা স্বাধীনতার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এই বাস্তবতা ভারতের সরকার ও রাজনীতিবিদদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান কেবল একটিই আছে, তা হলো কাশ্মীরের ভাগ্য কাশ্মীরি জনগণের হাতে ছেড়ে দেয়া। জাতিসংঘের গণভোটের যে প্রস্তাব রয়েছে তার বাস্তবায়ন সুরাহা নিশ্চিত করতে পারে। সামরিক শক্তি দিয়ে, দমন-পীড়ন চালিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কেন জয়ী হওয়া যায় না, সে কথা সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড লুইস তার ‘হোয়াট টেরোরিস্ট ওয়ান্ট’ বইয়ের ‘কেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কখনো জয়ী হওয়া যাবে না’ অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যে ব্যর্থ হয়েছে, এটাও তার প্রকৃষ্ট নজির। তাই সমাধান গোড়াতে গিয়েই করতে হবে।

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন