আসছে বাজেটে প্রবৃদ্ধির চেয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিশেষ নজর দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সম্প্রসারণমূলক বাজেট করতে বেশ কিছু সুপারিশও করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি নতুন কর আরোপ না করে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
গতকাল সোমবার সিপিডি ‘স্টেট অব দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি ইন ২০২০-২১’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব পরামর্শ দিয়েছে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে ‘জাতীয় অর্থনীতি পর্যালোচনা ও আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গ’ নিয়ে আলোচনা করেন প্রতিষ্ঠানটির অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি‘র ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্রামের প্রচ্ছন্ন বেকার মানুষগুলো এখনও শহরের দিকে আসার চেষ্টা করছে। এসব মানুষকে কিভাবে প্রণোদনার আওতায় আনা যায় তা মধ্য মেয়াদি কার্যক্রমের আওতায় খুঁজে বের করতে হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই মূহুর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক সুরক্ষা খাত শক্তিশালী করা। এই খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বরাদ্দের তুলনায় আমাদের বরাদ্দ সবচেয়ে কম। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ব্যয় করেত না পারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে এখন কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে এই খাতে একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ক্লিনিকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কিভাবে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা বাড়ানো যায় সেদিকে চিন্তা করতে পারে সরকার।
মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে চলমান করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সাধারণ মানুষ কর্ম হারাচ্ছে। কিন্তু সরকার সাধারণ বেকার মানুষের জন্য প্রণোদনার যে প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে তা বিপুল বেকারের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কাছে প্রণোদনা পৌঁছানোর কার্যক্রম তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক, সুধী সমাজ এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে তাতে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি এবংক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিশেষ নজর দিতে হবে।
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথম নয় মাস পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪২ শতাংশ। পরিচালন কার্যক্রমে অগ্রগতি ৫০ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) ১০ মাসের বাস্তবায়ন মাত্র ৪৯ শতাংশ। এরমধ্যে আবার বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ব্যয় করতে পেরেছে মাত্র ৩১ শতাংশ। অথচ চলমান করোনার চ্যালেঞ্জে মোকাবিলার জন্য চলতি অর্থবছর স্বাস্থ্য খাতে আগের চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ব্যয় করা যাচ্ছে না মন্তব্য করে সিপিডির এই গবেষক প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং বরাদ্দ ব্যয়ের উন্নতির জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, মহামারীর কারণে অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলার জন্য মধ্যবর্তী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে মহামারীকালে বৈষম্য দূরীকরণে মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কীভাবে বৈষম্য রোধ করা যায় তা মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে।
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের হালনাগাদ তথ্যও যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা বেকারদের প্রণোদনা প্রয়োজন অথচ তারা পান নি, তাদের কাছে কিভাবে পৌঁছানো যাবে তা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে বলে মনে করে সিপিডি।
তিনি বলেন, করোনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের খানা পর্যায়ে আয় বৃদ্ধিতেও সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাত ভাল অবস্থায় রয়েছে। তাই সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে সম্প্রসারণমূলক বাজেট গ্রহণ করা যায়। গবেষক তৌফিক ভোগ্য পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে বলেন, অনেক সময় দেশীয় উৎপাদিত চাল ডালের দাম ঠিক থাকছে না। আবার আমদানি পণ্যের দামও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকছে না। এজন্য মূল্য কমিশনসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ রাখেন তিনি।
বিশেষ করে আমদানি নির্ভর ভোগ্যপণ্য সয়াবিন তেল, আটা ও ময়দার দাম স্থানীয় বাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণে রেখে এই মহামারীতে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার কথা বলেন তিনি। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী বাজেটে আরও বরাদ্দের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোতে শহরের বেকার ও দরিদ্র মানুষকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ তার। পর্যালোচনা সভায় আরো বক্তব্য দেন সিপিডি‘র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন