শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

মসজিদুল আকসা : মুসলমানদের প্রথম কিবলা

মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২১, ১২:১৪ এএম

মসজিদুল আকসা, যা বায়তুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত। জেরুজালেমে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কিবলা। একে ঘিরে মুসলমানদের অন্তরে রয়েছে অপ্রতুল ভালোবাসার অভূতপূর্ব নিদর্শন। মুসলমানমাত্রই মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র এ ঘরটিকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে মনের গহিন থেকে। তাই তো যুগ যুগ ধরে এর উপর বয়ে যাওয়া সব প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে শত্রুর হাত থেকে একে রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিল মুসলিমগণ। অনেক রক্ত ঝরেছে পবিত্র এ মসজিদটিকে কেন্দ্র করে।
মুসলমানদের কাছে আল আকসা নামে পরিচিত এ মসজিদটি ইহুদিদের কাছে ‘টেম্পল মাউন্ট’ নামে পরিচিত। বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশেপাশের এলাকা বহু নবি-রাসুলের স্মৃতি বিজরিত স্থান, এখানে রয়েছে অসংখ্য নবি-রাসুলের মাজার। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘আল কুদসের (জেরুজালেম) এমন কোনো জায়গা খালি নেই যেখানে একজন নবি সালাত আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।’ (জামে তিরমিজি)। মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম শহরটি ‘আল কুদস’ নামেও পরিচিত।
মসজিদুল আকসার মোট ৭টি নাম রয়েছে। একটি হচ্ছে মসজিদুল আকসা। ‘আকসা’ শব্দের অর্থ দূরবর্তী। মসজিদুল আকসার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- দূরবর্তী মসজিদ। মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মিরাজের সূচনা হয়। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিলকৃত পবিত্র কুরআনের সূরা ইসরায় ‘মসজিদুল আকসা’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। সম্ভবত মক্কা থেকে এটি দূরে বলে আল্লাহ তাআলা এ মসজিদকে ‘দূরবর্তী মসজিদ’ বা মসজিদুল আকসা বলে অভিহিত করেন। আগে এর নাম ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বা বায়তুল মাকদিস। এর অন্য নামগুলো হচ্ছে- আল কুদস, মসজিদে ইলিয়া, সালাম, উরুশলেম ও ইয়াবুস।
মসজিদুল আকসা হচ্ছে ইসলামের প্রথম কিবলা। মহানবি হযরত হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম ১৬ মাস মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেন। পরবর্তিতে মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মুসলমানদের কিবলা মক্কার দিকে পরিবর্তিত হয়। হিজরি দ্বিতীয় সনের শাবান মাসের মাঝামাঝি সময়ে মহানবি হযরত হযরত মুহাম্মদ (সা.) কিছু সাহাবায়ে কিরামসহ মদিনার অদূরে মসজিদে বনু সালামায় জোহর মতান্তরে আসর নামাজ আদায় করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি সময়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবি (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম চার রাকাত বিশি’ নামাজের বাকী দুই রাকাত মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবা শরিফের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন বলে ইসলামের ইতিহাসে মসজিদটি মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র স্থান। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববি ও বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশ্যে সফরকে বিশেষভাবে সাওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি। এ সম্পর্কে মহানবি (সা.) ইরশাদ করেন- ‘তোমরা তিনটি মসজিদ ব্যতিত অন্য কোনো মসজিদে বিশেষ সাওয়াবের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ করো না। উক্ত তিনটি মসজিদ হলো- মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি এবং মসজিদুল আকসা।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। মহানবি (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন- ‘কোনো ব্যক্তি তার ঘরে এক রাকাত সালাত আদায় করলে এক রাকাত সালাতের সাওয়াবই পাবে। আর মসজিদে আদায় করলে ২৫ রাকাতের সাওয়াব পাবে এবং জুমুআর মসজিদে আদায় করলে ৫০০ রাকাতের সাওয়াব পাবে। আর মসজিদে নববিতে ও মসজিদুল আকসায় আদায় করলে ৫০ হাজার রাকাতের সাওয়াব পাবে এবং মসজিদুল হারামে আদায় করলে এক লক্ষ রাকাতের সাওয়াব পাবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
আল্লাহর রাসুল (সা.) এর পবিত্র মিরাজ জান্নাতি বাহন বোরাকে চড়ে শুরু হয়েছিল এই বায়তুল মুকাদ্দাস থেকেই। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্ত্বা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত- যার চারিদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রস্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)। এ আয়াতে কারিমায় মসজিদুল আকসার চারদিক বলতে জেরুজালেমকেই বোঝানো হয়েছে। জেরুজালেম শহরের নদী-নালা, মিষ্টি পানি ও ফল-ফলাদি হচ্ছে সেই জিনিস, যার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা এ শহরকে বরকতময় বলেছেন। এছাড়াও যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে যেখানে বহু নবি-রাসুল ও আউলিয়ায়ে কিরাম শায়িত আছেন, তাদের মত পূণ্যময় লোকদের জীবন-মৃত্যুর স্থান অবশ্যই বরকতময়।
মসজিদুল আকসার নির্মাণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। একদল ইতিহাসবিদ মনে করেন, মসজিদুল আকসা মূলত হযরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমেই তৈরি হয়। যা পরবর্তী নবিগণ পুণর্নির্মাণ ও সংস্কার করেন। আবার অনেকে মনে করেন, হযরত সুলায়মান (আ.) এ মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে সঠিক বক্তব্য হচ্ছে, হযরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাগৃহ নির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব (আ.) আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। একটি হাদিস থেকে জানা যায়- হযরত আবুজর গিফারি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞাসা করি, হে আল্লাহর রাসুল! সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন- মসজিদুল হারাম। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন- তারপর মসজিদুল আকসা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? তিনি বললেন- চল্লিশ বছরের ব্যবধান। (সুনানে ইবনে মাজাহ)। আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে- ‘পৃথিবীতে প্রথম মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল হারাম, যা হযরত ইবরাহিম (আ.) নির্মাণ করেছেন। আর মসজিদুল আকসা হচ্ছে দ্বিতীয় মসজিদ, যা মসজিদুল হারাম নির্মাণের চল্লিশ বছর পর হযরত ইয়াকুব (আ.) নির্মাণ করেন।’ হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর উপাধি ছিল ইসরাইল। তাঁর দিকে সম্বোধন করে তাঁর বংশধরকে বনি ইসরাইল বলা হয়। হযরত ইয়াকুব (আ.) তার বংশ বনি ইসরাইলসহ জেরুজালেম বসবাস করতেন। কিন্তু তার শেষ বয়সে বনি ইসরাইল হযরত ইউসুফ (আ.)-এর আহবানে মিশর প্রবেশ করেন। হযরত ইউসুফ (আ.) হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর সন্তান ও আল্লাহর নবি ছিলেন। পরবর্তীতে বনি ইসরাইল মিশরে ফিরাউনের দ্বারা নির্যাতিত হয়। হযরত মুসা (আ.)-এর যুগে তাঁর সাহায্যে বনি ইসরাইল মিশর ত্যাগ করে। ফলে পুনরায় তাদের জেরুজালেমের পবিত্র স্থানে ফিরে আসার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু জেরুজালেমের জালেম অধিবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে। তাদের ভীরুতা ও কাপুরুষতার জন্য আল্লাহ তাআলা সিনাই মরু প্রান্তরের তীহ ময়দানে তাদেরকে ৪০ বছর মরু জিন্দেগী যাপনের শাস্তি প্রদান করেন। বনি ইসরাইল সিনাই মরুভূমির কঠিন পানিশূন্য তীহ প্রান্তরে পানির পিপাসায় অস্থির হয়ে হযরত মুসা (আ.)-এর কাছে পানি প্রার্থনা করল। হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে পানির আবেদন করলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নিজ লাঠি দ্বারা একটি পাথরে আঘাত করার নির্দেশ দেন। ফলে ১২ গোত্রে বিভক্ত বনি ইসরাইলের জন্য ১২ টি ঝর্ণাধারা ফুটে উঠল। সেই পানি থেকে তারা সবাই প্রয়োজন পূরণ করতে লাগল। এরপর তাদের খাদ্য সমস্যা দেখা দিল। তারা হযরত মুসা (আ.)-এর কাছে খাবার চেয়ে বসল। হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দোয়া কবুল করলেন এবং বনি ইসরাইলের জন্য ‘মান্না ও সালওয়া’ নামক খাদ্য পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর বনি ইসরাইল হযরত মুসা (আ.)-এর কাছে ফরিয়াদ করে- ‘হে মুসা (আ.)! আমরা একই প্রকার খাবারের উপর বিরক্ত হয়ে পড়েছি। তুমি তোমার রবের কাছে প্রার্থনা কর, যেন আমাদেরকে জমিনের উৎপাদিত সবজি-তরকারি, সিম, ডাল ও পেঁয়াজ দান করেন।’ এতে হযরত মুসা (আ.) রাগ করেন এবং প্রশ্ন করেন, ‘তোমরা কি নিকৃ’ জিনিসের জন্য উৎকৃ’ জিনিসের পরিবর্তন কামনা কর? যদি তাই চাও তাহলে তোমরা শহরে ছড়িয়ে পড় এবং সেখানে তোমরা যা চাবে তাই পাবে।’ এদিকে হযরত মুসা (আ.) আল্লাহ তাআলার সাথে নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৩০ দিনের জন্য তুর পাহাড়ে গমন করেন। এসময়ে সামেরি নামক এক লোকের কুপরামর্শে বনি ইসরাইল গো-বাছুরের পূজা আরম্ভ করে। হযরত মুসা (আ.) ফিরে এসে নিজ সম্প্রদায়ের উপর অত্যন্ত রাগান্বিত হন।
তাদের এই অপরাধের জন্য আকাশ থেকে এক বজ্রপাতের মাধ্যমে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তখন হযরত মুসা (আ.) তাদের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পুনরায় জীবন দান করেন। কিন্তু বনি ইসরাইল হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বনি ইসরাইলের অধিকাংশ লোক এই সাম’িক বিদ্রোহের আহবানে সাড়া দেয়। তারা হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এবং বলে, তোমরাই বনি ইসরাইলের ধ্বংসকারী। আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-এর অনুসারী সত্যপন্থীদেরকে সাহায্য করেন এবং ১৪ হাজার বিদ্রোহীদেরকে এক মহামারীর মাধ্যমে ধ্বংস করে দেন। তীহ প্রান্তরের অবশি’ লোকদের জন্য ৪০ বছর সশ্রম দন্ড ঘোষণা করে বলা হয়, তাদেরকে এই ময়দানে ৪০ বছর কাটাতে হবে। তীহ ময়দানে হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.) ইন্তিকাল করেন। তাঁরা দুইজন জেরুজালেমে প্রবেশের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। যখন তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, এই কাপুরুষ জনগোষ্ঠিকে নিয়ে জেরুজালেম জয় করা সম্ভব নয় তখন তাঁরা জেরুজালেমের অতি নিকটে পাথর নিক্ষেপের দূরত্বের মধ্যে নিজেদের লাশ দাফনের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। তাঁদের প্রার্থনা মোতাবেক তাঁদেরকে জেরুজালেমের কাছে দাফন করা হয়।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন