পূর্ব প্রকাশিতের পর
এদিকে হযরত মুসা (আ.) আল্লাহ তাআলার সাথে নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৩০ দিনের জন্য তুর পাহাড়ে গমন করেন। এসময়ে সামেরি নামক এক লোকের কুপরামর্শে বনি ইসরাইল গো-বাছুরের পূজা আরম্ভ করে। হযরত মুসা (আ.) ফিরে এসে নিজ সম্প্রদায়ের উপর অত্যন্ত রাগান্বিত হন। তাদের এই অপরাধের জন্য আকাশ থেকে এক বজ্রপাতের মাধ্যমে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তখন হযরত মুসা (আ.) তাদের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পুনরায় জীবন দান করেন। কিন্তু বনি ইসরাইল হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বনি ইসরাইলের অধিকাংশ লোক এই সামষ্টিক বিদ্রোহের আহবানে সাড়া দেয়। তারা হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এবং বলে, তোমরাই বনি ইসরাইলের ধ্বংসকারী। আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-এর অনুসারী সত্যপন্থীদেরকে সাহায্য করেন এবং ১৪ হাজার বিদ্রোহীদেরকে এক মহামারীর মাধ্যমে ধ্বংস করে দেন। তীহ প্রান্তরের অবশিষ্ট লোকদের জন্য ৪০ বছর সশ্রম দন্ড ঘোষণা করে বলা হয়, তাদেরকে এই ময়দানে ৪০ বছর কাটাতে হবে। তীহ ময়দানে হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.) ইন্তিকাল করেন। তাঁরা দুইজন জেরুজালেমে প্রবেশের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। যখন তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, এই কাপুরুষ জনগোষ্ঠিকে নিয়ে জেরুজালেম জয় করা সম্ভব নয় তখন তাঁরা জেরুজালেমের অতি নিকটে পাথর নিক্ষেপের দূরত্বের মধ্যে নিজেদের লাশ দাফনের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। তাঁদের প্রার্থনা মোতাবেক তাঁদেরকে জেরুজালেমের কাছে দাফন করা হয়।
হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-এর পরবর্তী নবি হলেন হযরত ইউশা বিন নুন (আ.)। তিনি বনি ইসরাইলের পরবর্তী বংশধরদেরকে নিয়ে জেরুজালেমে পৌঁছেন। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেন এবং বিজয়ীর বেশে সেখানে প্রবেশ করেন। হযরত ইউশা বিন নুন (আ.)-এর পরবর্তী সময়ে আমালিকা সম্প্রদায়ের লোকেরা বনি ইসরাইলের উপর আক্রমণ করে তাদের কাছ থেকে জেরুজালেমের অধিকাংশ এলাকা কেড়ে নেয়। পরবর্তীতে হযরত দাউদ (আ.) জেরুজালেম শহর দখল করেন। হযরত দাউদ (আ.)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর সন্তান হযরত সুলায়মান (আ.) জেরুজালেমের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১০০৪ সালে আল আকসা মসজিদের পুণর্নির্মাণ করেন। এই মসজিদ নির্মাণে ৩০ হাজার শ্রমিকের সাত বছর সময় লেগেছিল। তিনি খুবই সুন্দর ডিজাইনে মসজিদটি নির্মান করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙিনা, মিম্বর, মেহরাব ও অভ্যন্তরীণ কাঠামো।
৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সাহাবি হযরত আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে সমগ্র বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের দখলে আসার পর মুসলিম শাসকরা কয়েকবার এ মসজিদের সংস্কার করেন। কিন্তু ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিস্টান সেনাপতি গডফ্রে ডিবো ইউনের নেতৃত্বে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর আল আকসা মসজিদের ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গীর্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা প্রচন্ড উন্মত্ততা সহকারে জেরুজালেমে প্রবেশ করে সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদস। তারা মসজিদুল আকসাকে গীর্জায় রূপান্তরিত করে এবং মসজিদের গম্বুজের উপরে ক্রুশ স্থাপন করে এর নাম রাখে ‘সুলায়মানি উপাসনালয়’। মসজিদের এক অংশকে ঘোড়ার আঁস্তাবল বানায় এবং অন্য অংশে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করে।
এভাবেই আল কুদসে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। এরপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা, পরাধীনতার শিকল ভেঙে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য মুসলিম মিল্লাত অপেক্ষা করেছিল একজন মুক্তিদূতের। এরপর ১১৮৭ সালে হিত্তিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইউবি (রহ.) জেরুজালেম শহর মসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। এ সময়ে পূর্বের নকশা অনুযায়ী আল আকসা মসজিদের পুণর্নির্মাণ করা হয়।
মসজিদটিতে ২ টি বড় এবং ১০ টি ছোট গম্বুজ রয়েছে। এ মসজিদ নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বর্ণ, সিসা এবং মার্বেলসহ বিভিন্ন প্রকার পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। ঐতিহাসিক এ মসজিদটির আয়তন সাড়ে তিন হাজার বর্গমিটার। এ মসজিদে পাঁচ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইউবি (রহ.)-এর হাতে পরাজিত হওয়ার পর খ্রিস্ট শক্তি পিছু হটলেও ইহুদি চক্র বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে লোলুপ দৃষ্টি রাখে। তারা ফিলিস্তিন থেকে নিয়ে সুদূর মদিনা পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করে বসে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বিশ্ব মোড়লদের চক্রান্তে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া অভিশপ্ত ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক এই চারটি আরব দেশের প্রতিরোধ ব্যূহ ধ্বংস করে ইসরাইল পূর্ব আল কুদস , পশ্চিম তীর, গাজা ও গোলান মালভূমি দখল করে নেয়।
বর্তমানে ইহুদিবাদি ইসরাইল ঐতিহাসিক এই মসজিদটি দখল করে রেখেছে। ১৯৬৯ সালে তারা একবার আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগও করেছিল।
বর্তমানে এ মসজিদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ইসরাইলের মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসায় প্রবেশ ও নামাজ আদায় করতে পারে। আবার অনেক সময় বাঁধাও দেওয়া হয়। এই বিধি-নিষেধের মাত্রা সময়ে সময়ে পরিবর্তন করা হয়। কখনো শুধু জুমুআর সালাতের সময় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। গাজার অধিবাসীদের জন্য বিধি-নিষেধ অনেক বেশি কঠোর। ইসরাইল সরকারের দাবি, নিরাপত্তার কারণে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
ঐতিহাসিকভাবেই মসজিদুল আকসা মুসলমানদের পবিত্র স্থান। হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলায়মান (আ.) হযরত মুসা (আ.)-এর পরবর্তী নবি ছিলেন। ইসলাম সকল নবির উপর ইমান আনার নির্দেশ দিয়েছে। তাই হযরত সুলায়মান (আ.) কর্তৃক নির্মিত মসজিদুল আকসা আজ মুসলমানদেরই স্বাভাবিক উত্তরাধিকার। সেখানে ইহুদিদের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক অধিকার কিংবা ঐতিহ্যের আবদার চলে না। কেননা হযরত সুলায়মান (আ.) ইহুদিদের সরাসরি নবি ছিলেন না। বরং মুসলমানরাই হযরত সুলায়মান (আ.)-এর যথার্থ উত্তরাধিকারী। তাছাড়া হযরত মুসা (আ.)-এর উপর তুর পাহাড়ে তাওরাত নাযিল হলেও তিনি ফিলিস্তিনে বাস করেননি এবং ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তা সম্ভবও হয়নি। সে কারণে ‘জেরুজালেম তাওরাত কিংবা ইহুদিদের ভূমি’ সংক্রান্ত ইসরাইলি দাবি সম্পূর্ণ অর্থহীন। বরং মহানবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মিরাজে গমন করার কারণে তা ইসলামেরই পবিত্র স্থান ও পুণ্যভূমি।
এ মসজিদকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর পাসকৃত এক প্রস্তাবনায় বলা হয়, জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদের উপর ইসরাইলের কোনো অধিকার নেই, আল আকসা মুসলমানদের পবিত্র স্থান। মুসলমানরা তাদের প্রথম কিবলা ও তৃতীয় পবিত্রতম স্থান দ্রুত ফিরে পাক- শান্তিপ্রিয় বিশ্বমানবতার এটাই একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন