শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

দেশে দেশে রোজার উৎসব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২৩, ১২:০২ এএম

মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়, কুরআনে সূরা আত্তাওয়াবার ৩৬নং আয়াতে সেই এক বৎসর বার মাসে গঠিত হয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট মাসমূহের সংখ্যা হচ্ছে ‘বারো’, ইহা আল্লাহর গ্রন্থে লেখা’’।
চান্দ্র বৎসরের বার মাসের মধ্যে শুধু রমজান মাসের নাম কুরআনে উল্লেখ আছে। সুরা আল-বারাকার ১৮৫নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- “রমজান সেই মাস, যাতে কুরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। যে কুরআন মানব জাতির পথ প্রদর্শক এবং যাতে সঠিক পথের নিদর্শনসমূহ প্রদত্ত হয়েছে এবং যা সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী। অতএব এই মাস যারা প্রত্যক্ষ করবে তাদেরকে সিয়াম পালন করতে হবে। আর যদি কেহ অসুস্থ হয় কিংবা ভ্রমণ অবস্থায় থাকে, তবে সে যেন অন্যান্য দিনে এই সিয়ামের সংখ্যা পূর্ণ করে লয়। বস্তুত আল্লাহ তোমাদের কাজ সহজ করে দিতে চান, কোনরূপ কঠোরতা আরোপ করা আল্লাহর ইচ্ছা নেই। তোমাদেরকে এই জন্য বলা হচ্ছে যে, তোমরা সিয়ামের সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে সত্য পথের সন্ধান দিয়েছেন সেই জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পার’’।
এই মাসে আল্লাহ তা’য়ালা মুসলমানদের উপর সিয়াম ফরয করে দিয়েছেন। কুরআন মাজীদে সূরা আল-বাকারা, আন নিসা, আল মায়িদা, মারিয়ম, আল আহযাব ও আল মুজাদালাহ এই ছয়টি সূরায় মোট চৌদ্দবার সিয়াম শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। তবে সিয়ামের বিধান সম্বলিত আয়াতগুলোর একত্র সমাবেশ ঘটেছে সূরা আল-বাকারায়। তাছাড়া সহীহ্ হাদীস গ্রন্থগুলোতে সিয়ামের মাহাত্মা, মর্যাদা ও বিধি-বিধান সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে সূরা আল বাকারার ১৮৩ ও ১৮৪ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে। যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা তাকওয়ার গুণে ভূষিত হতে পার। অল্প কয়েকদিনের জন্য মাত্র তোমাদের মধ্যে কেহ অসুস্থ থাকলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় হিসাব গণনা করে সিয়াম রাখবে’’।
কুরআনের সূরা আল বাকারায় যে অংশে আল্লাহ সুবহানু তা’য়ালা রমজান ও সিয়াম প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন সেখানে তিনি আরও বলেছেন, “যখন তোমার কাছে আমার কোন বান্দা আমার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করবে তখন বলে দিবে আমি তো নিশ্চিতভাবেই তোমাদের নিকট অবস্থান করছি। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা শুনে থাকি। অতএব তাদের উচিত আমার ডাকে সাড়া দেওয়া। যাতে করে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হতে পারে’’ (২:১৮৬)।
মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো কুরআনের আলোকে জীবন ও সমাজ গড়া। এ কাজের জন্যে আল্লাহ নিজেই তাকওয়াকে শর্ত বানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “এই কুরআন আল্লাহর কিতাব এতে কোনই সন্দেহ নেই, আর এটি পথের দিশারী তাঁদের জন্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী’’ (২:২)।
আদম (আ:) থেকে নূহ (আ:) পর্যন্ত প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে যে সিয়াম ফরয ছিল, তাকে বলা হয় ‘আইয়ামে বীয’ (উজ্জল দিন) এর রোযা। মুহররমের দশ তারিখে অর্থাৎ আশুরার সিয়াম হলো মুসা (আ:) এর শুকরানা সিয়াম। এ দিনে আল্লাহ তা’য়ালা মুসা (আ:) ও তাঁর অনুসারীদিগকে ফিরআউন ও তার সৈন্যদের আক্রমণ হতে রেহাই দিলেন এবং ফিরআউন ও তার সমস্ত সৈন্যদেরকে পানিতে ডুবিয়ে মারলেন (বুখারী, মুসলিম)। ইহুদী ও খৃষ্টানদের উপর যে ৪০ দিন উপবাস ফরয তাকে খবহঃ বলা হয়। অবশ্য খৃষ্টানদের খুব কম লোকই এই উপবাস পালন করে। মুসলমান ও আহলে কিতাবদের (ইহুদী ও নাসারা) সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হলো, মুসলমানরা সেহরী খায় আর আহলে কিতাবরা তা খায় না (মুসলিমÑ। আল্লাহ কর্তৃক যেসব ধর্মমত প্রেরিত হয়নি তাদের মধ্যেও কোন না কোন ভাবে প্রাচীনকাল থেকে উপবাসের বিধানের খবর পাওয়া যায়। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের দ্বিতীয় সালে মুসলমানদের উপর একমাস সিয়াম ফরয করা হয়। আল-কুরআনের বর্ণনা-“যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর’’। এতে সিয়ামের ঐতিহাসিক সত্যতাই প্রমাণ করে।’’
বলা হয়, কল্ব যখন ভাল থাকে তখন শরীরও ভাল থাকে, আর কল্ব যখন বিকৃত হয়ে পড়ে তখন শরীরও বিকৃত হয়ে পড়ে। এই কল্বকে ভাল রাখবার জন্যই ইসলামে সিয়াম, সালাত ও যিক্র পদ্ধতির ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিয়ামের স্থান উর্ধ্বে। কারণ সিয়াম দ্বারা মানুষ মুত্তাকী হতে পারে। আল্লাহর গুণে সর্বাধিক গুণান্বিত হবার বাস্তব অনুশীলন হচ্ছে সিয়াম সাধনা। ইসলামের যে পাঁচটি স্তম্ভ আছে তার মধ্যে সিয়ামকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-“সিয়াম খাস আমার ভয়ে হয়। এর বদলা আমি নিজে দিব’’ (বুখারী, মুসলিম)।
ধনী-দরিদ্র সকল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর উপর সিয়াম ফরয। এই সিয়াম পালন ছাড়া সালাত, যাকাত, হজ্ব এমনকি কলেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না’ (সিয়াম ও তারাবীহ-আবু মুহাম্মদ আলীমুদ্দীন, ১৩৯৯ হি:)। ধন ও মালের যেমন যাকাত আদায় করতে হয় ঠিক তেমনি সিয়াম শরীরের যাকাত স্বরূপ।
রোযা ফার্সী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ‘উপবাস’। প্রচলিত রোযা শব্দটি আরবী ‘সিয়াম’-এর স্থান অধিকার করছে। নিছক উপবাস সিয়ামের প্রতিশব্দ নয়। ‘রময’ শব্দ হতে রামাযানের উৎপত্তি। এর বুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ‘দাহন’ বলা যায় অসৎ প্রবৃত্তির দাহন’। কেহ কেহ বলে থাকেন যে, ‘রামাযান’ আল্লাহর অন্যতম নাম, অতএব উহা বুৎপত্তি সিদ্ধ নয়। এই প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ, দেহলভী (র:) বলেছেন, “যেহেতু পাশবিক বাসনার প্রাবল্য ফেরেশতা-সুলভ চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায়, সুতরাং এর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত। অতএব এই উপকরণগুলোকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করা হচ্ছে সিয়ামের সূক্ষ্ম তাৎপর্য’’। আরবীতে আমরা যাকে ‘সওম’ বলি তার বহুবচন হলো ‘সিয়াম’। শব্দটির মৌলিক অর্থ ‘বিশ্রাম লওয়া’ ‘বিরত থাকা’। শরীয়তে এর অর্থ আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে সুবেহ সাদিকের প্রারম্ভ হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় চর্চা হতে বিরত থাকা। কাজেই স্পষ্টই বোঝা যায় সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পাশবিক প্রবৃত্তি দমন। সিয়ামের মাধ্যমে তা সম্ভব বলে যুগে যুগে নবী-রসুলগণ ওহী লাভের প্রাক্কালে সিয়াম পালন করতেন।
রমজান মাস মুসলিম বিশ্বে অতি পবিত্র মাস। এই মাসে আল্লাহ তা’য়ালা বেহেশতের দরজা খুলে দেন আর দোযকের দরজা বন্ধ করে দেন। এই মাসের মর্যাদা এই জন্য বেশি যে, আসমানী কিতাবের প্রায় সবগুলো এই মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআন শরীফ ছাড়া ইবরাহীম (আ:) এর সহীফা, দাউদ (আ:) এর যাবুর, মুসা (আ:) এর তাওরাত এবং ঈসা (আ:) এর ইঞ্জিল এই রামাদ্বান মাসেই অবতীর্ণ হয়। ঈসা (আ:) তাঁর মা মরিয়মের গর্ভে আল্লাহর এক মহান কুদরতী নিদর্শন-স্বরূপ জন্মগ্রহণ করেন। যেদিন তিনি ভূমিষ্ঠ হন সেদিন তাঁর মা রোযা ছিলেন (সূরা মরিয়াম : ২৬)। বুখারী আবু হুরায়রা (রা.) এর বাচনিক, নাবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়ামকে এমন এক ঢাল হিসাবে বিবৃতি করেছেন যা ইহকালে মানুষকে মন্দ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং পরকালে দোযখের আগুন হতে বাঁচিয়ে রাখে। বায়হাকী সালমান ফারসী (রা:) প্রমুখাৎ রেওয়ায়েত করেছেন যে, নাবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের শুরুতে এবং শাবান মাসের শেষতম দিবসে তাঁর অভিভাষণে বলেছেন, “হে জনমন্ডলী! একটি মহান বরকতপূর্ণ মাস তোমাদের উপর ছায়ার মত এসেছে। এটি এমন মাস যার একটি রাত এক হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম। এই মাসের সিয়াম আল্লাহ ফরয করেছেন’’ (মিশকাত)।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তৃতীয় বুনিয়াদ হচ্ছে রমজান মাসের সিয়াম। সিয়াম যাদের উপর ফরয তারা যদি বিনা কারণে একটি সিয়াম ইচ্ছাকৃত ভাবে না করে তাহলে সারা জীবন সিয়াম রাখলে ওই বিনা কারণে ইচ্ছাকৃত ভাঙ্গা সিয়ামটির কাফ্ফারা হবে না (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, আহমদ, মেশকাত)
উল্লেখিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় রামাদ্বানের সিয়ামের গুরুত্ব কত বেশি। সিয়ামের আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক গুরুত্ব বিবরণ করতে যেয়ে নাবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, “এই মাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম দশদিন আল্লাহর রহমত নাযিলের, মধ্যবর্তী দশদিন ক্ষমা ও গুনাহ মাফের এবং শেষতম দশদিন দোযখ হতে মুক্তি পাবার সৌভাগ্যকাল’’ (বায়হাকী)।
তিনি আরও বলেছেন, “মানুুষের প্রতিটি ভাল কাজের প্রতিফল দশ হতে সাত শত গুণ বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু সিয়ামের প্রতিফল অগনন’’ (বুখারী, মুসলিম। নাবীজী আরও বলেছেন, “সিয়াম পালনকারীর উদ্দেশ্যে দুটি আনন্দকে তাদের ভাগ্যের জন্য নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, সিয়াম পালনকারী যে আনন্দ ইফতারের সময় লাভ করে থাকে। দ্বিতীয়, কিয়ামতের দিন স্বীয় প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময় যা সে অনুভব করবে’’ বুখারী, মুসলিম)। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন