শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

উস্তাযুল হুফ্ফাজ হাফেজ হাফিজুল্লাহ (রহ.)-এর বর্ণাঢ্য জীবন

মাওলানা মুহাম্মদ জিয়াউল হক | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২৩, ১২:০২ এএম

উস্তাযুল হুফ্ফাজ হাফেজ হাফিজুল্লাহ (রহ.) ছিলেন লক্ষাধিক হাফেজ গড়ার দেশখ্যাত কারিগর। নরসিংদী জেলার ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষের প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয় আরাবিয়া দক্ষিণ মির্জানগর-এর সুদীর্ঘ ৫০ বছরের সফল পরিচালক। এদেশে যে ক’জন মহামনীষী কোরআনের ব্যাপক খেদমত করে গেছেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম বিসর্জিতপ্রাণ। পবিত্র কোরআন হিফজ করার মতো মহৎ শিক্ষাÑ এদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহর-নগরে প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে অক্লান্ত মেহনত করেছেন। যারাই তাঁর কাছ থেকে কোরআন হিফজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন তিনি যে কতটা দরদী মুখলিস উস্তাদ ছিলেন। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিরলসভাবে মৃত্যু অবধি কোরআনের খেদমত মশগুল ছিলেন।
জন্ম : হাফেজ হাফিজুল্লাহ (রহ.) ১৩৫২ বাংলা ও ১৯৪৫ সালের জুন মাসের ৪ঠা আষাঢ় বুধবার, নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানাধীন দক্ষিণ মির্জানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পৈত্রিকসূত্রে বসতবাড়ি শিবপুর থানার চৈতন্য গ্রামে। তবে মাদরাসা পরিচালনার সুবিধার্তে স্বপরিবারে মির্জানগরেই থাকতেন। তার পিতার নাম হাফেজ আবুল কাসেম (রহ.) তার প্রথম সন্তান মারা যায়। বছর দু’য়েক পরে কাসেম সাহেবের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় আরেকটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান। পূর্বের সন্তান মারা যাওয়ার শোক এখনও ভুলতে পারেন নি। পিতার মনে একটা ভয় ঝেঁকে বসেছে এ কলিজার টুকরা সন্তান আবর না জানি...। সন্তান জন্মের সুসংবাদ নিয়ে ছুটে যান ওই সময়ের যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহর ওলী পিরজী হুজুর (রহ.)-এর কাছে। হুজুরকে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সুসংবাদ দিলেন। পূর্বের ঘটনাও হয়ত স্ব-বিস্তারে শুনিয়েছেন। সদ্যভুমিষ্ট নবজাতক সন্তানের জন্য দোয়া চাইলেন এবং একটা নাম রেখে দেয়ার আরজি পেশ করলেন। পিরজী হুজুর রহ. নবজাতকের নাম রাখেন ‘হাফিজুল্লাহ’ (অর্থ : আল্লাহ হেফাজতকারী)
শিক্ষা : পিতা হাফেজ আবুল কাসেম (রহ.)-এর কাছে ৬ বছর বয়সে হিফজ শুরু করেন। বাবার কোলে বসে শুধুমাত্র মুখ থেকে শুনে শুনে ১০ পারা কোরআন শরীফ মুখস্ত করে ফেলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, তখনও তার কায়দা-ছিপারা পড়া হয়নি। এমনকি আরবি অক্ষরগুলোও ভালো করে চিনে সারতে পারেন নি। কিছুদিন পর বড়কাটারা মাদরাসায় ভর্তি হন। হাফেজ মীর আহমদ রহ.-এর কাছে মাত্র ১১ বছর বয়সে হিফজ শোনানিসহ শেষ করেন। ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ায় কিতাব বিভাগে ভর্তি হন। উস্তাদদের সাথে গড়ে উঠেছিল তাঁর সুগভীর সম্পর্ক। সুন্দর আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। জামিয়ার মুহতামিম যুগশ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা আতহার আলী রহ. তাঁকে খুব আদর করতেন। বিভিন্ন মাহফিলে তিনি প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। প্রিয় ছাত্র হাফিজুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। বয়ান শুরু করার পূর্বে শাগরিদ হাফিজুল্লাহ’র দিলকাশ কোরআনের তেলাওয়াত শ্রোতাদের শুনাতেন। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া অনেকটা দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই কাফিয়া পর্যন্ত পড়ে শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন।
কর্মজীবন : মুন্সিগঞ্জের মোস্তুফাগঞ্জ মাদরাসায় হিফজ বিভাগে কোরাআনের খেদমত দিয়ে শুরু করেন কর্ম জীবন। কিছুদিন না যেতেই দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা হাফেজ হওয়ার জন্য মৌমাছির মতো ছুটে আসতে থাকে। গ্রামের লোকেরা মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলে তিনি বলেন, ‘আমিতো এখানে আসছি ছাত্রদের কোরআন পড়ানোর জন্য।’ একপর্যায় তিনি সেখান থেকে চলে আসেন। ঢাকায় অন্য আরেকটি মাদরাসায় কিছুদিন খেদমত করেন। ধীরে ধীরে তার শিক্ষকতার সুনাম-সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ মির্জানগর মাদরাসার পরিচালনা পর্ষদ হুজুরকে নিয়ে আসেন এবং হিফজ বিভাগের দায়িত্বে বসিয়ে দেন। প্রতিষ্ঠানের দুর্দিনেও তিনি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে শক্তহাতে হাল ধরেছেন। বন্যা চালকালীন সময়েও দুই ছেলেকে কাঁধে নিয়ে পানি ভেঙে মাদরাসায় চলে আসতেন এবং পড়ালেখার কার্যক্রম চালু রাখতেন। এমনকি ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়ও তিনি মাদরাসা চালু রেখেছেন, যাতে ছাত্ররা কোরআনের হিফজ ভুলে না যায়। যদিও এর জন্য তিনি বেশ হুমকির সম্মুখিন হয়েছেন। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন