শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রক্তাক্ত ফিলিস্তিনের অতীত ও বর্তমান

ড. মোঃ কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০২১, ১২:০৮ এএম

খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগের কথা। ফিলিস্তিনে জন্ম নিয়েছিলেন ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.), ইইসুফ (আ.), যাকারিয়া (আ.) ও ঈসা (আ.)সহ অনেক নবী ও রাসুল। ফিলিস্তিনের পার্শ্ববর্তী দেশ জর্ডানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নূহ (আঃ), লূত (আ.) ও আইউব (আঃ)। আরেক পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননে জন্ম নেন সালেহ (আ.)। পাশের দেশ মিশরে জন্ম নেন মুসা (আ.), হারুন ও শুয়াইব (আ.)। এসকল নবী-রাসুল ছিলেন সমসাময়িক যুগের পথপ্রদর্শক ও সংশ্লিষ্ট দেশের জনপ্রতিনিধি। ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায়, ইয়াকুব (আ.)এর বংশধরেরা খ্রিস্টপূর্ব তেরোশ’ বছর ধরে ফিলিস্তিন শাসন করতেন। দাউদ (আ.) তাঁর শাসনামলে জেরুজালেমে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। আর তাঁর পুত্র সুলায়মান (আ.) নির্মাণ কাজ শেষ করেছিলেন। এ মসজিদেই মিরাজের রজনীতে সকল নবীর আগমন ঘটেছিল। আর শেষ নবী মুহাম্মাদ (স.)এর ইমামতিতে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দাউদ (আ.)-এর মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করেন তাঁরই পুত্র সুলাইমান (আ.)। আর এতসব কারণেই ফিলিস্তিন, জেরুজালেম ও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলিমবিশ্বে পূণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। নবী সুলাইমান (আ.)-এর পরে ইতিহাসের গতিধারায় ফিলিস্তিনে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানরা বসবাস করতে থাকে। কিন্তু ইহুদিরা তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অন্যদের পাত্তা না দিয়ে নিজেরা জুদাহ নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করে। জেরুজালেমকে তারা রাজধানী ঘোষণা করে। এতে খ্রিস্টান এবং মুসলিমরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৩২ সালে খ্রিস্টান রাজা কনস্টানটিন (রোমান স¤্রাট) ইহুদিদেরকে জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করেন। ফিলিস্তিন ঈসা (আ.)-এর জন্মভূমি হওয়ার কারণে খ্রিস্টানদের কাছে সেটি হয়ে ওঠে বিশেষ পূণ্যভূমি। অবশ্য সপ্তম শতাব্দীতে রোমানরা মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। ফিলিস্তিন চলে আসে আবার মুসলিম শাসনের অধীনে। এ সময় থেকে পরবর্তী ১২০০ বছর পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল স্বাধীন এক মুসলিম জাতিরাষ্ট্র। হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন ইহুদি এ সময় ফিলিস্তিনে বসবাস করত। রোমানদের কাছে পরাজিত হয়ে ইহুদিরা ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নীতিভ্রষ্টতার কারণে কোন দেশেই তাদের জায়গা হয়নি। ভূমিহীন যাযাবর-রিফিউজি হিসেবে বিভিন্ন দেশের বস্তিতে তারা বসবাস করতে থাকে। সৃষ্টিলগ্নের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইহুদিদের স্থায়ী কোনো বসতভিটা ছিল না। তারা কোনো জাতির সাথেই মিলেমিশে বাস করতে পারেনি। তাই এভাবেই তারা নির্বাসিত জীবনযাপন করতে থাকে। ওদিকে সৃষ্টির শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তাই ইউরোপ-আমেরিকার লোভাতুর দৃষ্টি ছিল এসব দেশের প্রতি। তাই পূর্ব থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একটি মিত্র ও বন্ধু রাষ্ট্র গঠনের বাসনা ছিল। ওদিকে যাযবর জীবন থেকে মুক্তির জন্য ইহুদিরাও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিকলাপনা করতে থাকে। আর এ লক্ষ্যে তারা গড়ে তোলে ‘জায়নবাদি সংগঠন’। একদিকে ইউরোপ-আমেরিকার বাসনা, অন্যদিকে ইহুদিদের পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তুতি শুরু করে।

সপ্তম শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ ১২০০ বছর পর্যন্ত ফিলিস্তিন বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল। সেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিস্টান এবং স্বল্পসংখ্যক ইহুদিও বসবাস করত। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩.২ শতাংশ। ১৯১৪ সালে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তিন ছিল উসমানীয় সা¤্রাজ্যের অধীনে। আর উসমানীয় সা¤্রাজ্য ছিল ব্রিটিশ বলয়ের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে ব্রিটিশবলয় বিজয়ী হয়। ফলে উসমানীয় সা¤্রাজ্য ভেঙ্গে যায়। আর ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশকর্র্তৃক ফিলিস্তিন শোষিত হয়। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনিদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এ আশ্বাসের উদ্দেশ্য ছিল, ফিলিস্তিনে তাদের শাসনসীমা দীর্ঘায়িত করে ইহুদীদের প্রতিষ্ঠিত করা। এরই মধ্যে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বেইজম্যান দুর্লভ বোমা তৈরি করেন। যা ব্রিটিশদের যুদ্ধজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ ভূমিকার উপহারস্বরূপ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুরু হয় ইহুদি বসতি স্থাপনের কার্যক্রম। ১৯২২ সালে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জাহাজ ভর্তি ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে। আর তাদেরকে পুনর্বাসন করতে অর্থযোগান দিতে থাকে ব্রিটিশরা। এ দীর্ঘ সময়ে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি ফিলিস্তিনকে আরব ও মুসলিম শূন্য করার কাজটি ভালোভাবে সেরে নেয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু ততদিনে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মাটির গভীরে শিকড় গেড়ে বসে। ১৯১৮ সালে ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। ১৯২৩ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে। ১৯৩১ সালে এ সংখ্যা হয় ১ লাখ ৮০ হাজারে। আর ১৯৪৮ সালে এ সংখ্যাটি উন্নীত হয় ৬ লাখে। ঠিক এ দীর্ঘ সময় ধরে ইহুদিরা ব্রিটিশদের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত শক্তিশালী সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তোলে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের উচ্ছেদ অভিযান। দ্রুততার সাথে চলতে থাকে ইহুদিদের বসতিস্থাপন। ফলশ্রুতিতে ২০ লাখ বসতির মধ্যে ইহুদির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখে। এভাবে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের কাজ এগিয়ে যেতে থাকে দ্রুত গতিতে। অবৈধ ও অযৌক্তিক রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক বৈধতা পেতে জোর লবিং চালাতে থাকে। ওদিকে ১৪ মে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হবার কথা। সুতরাং যা করবার দ্রুত করতে হবে। ইহুদি-ব্রিটিশের জোর লবিং বিষয়টিকে নিয়ে যায় জাতিসংঘে। আর ব্রিটিশ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন নিয়ে ‘দ্বিজাতিতত্ত¡ প্রস্তাব পাশ করে। প্রাচীন ফিলিস্তিন ভেঙ্গে তৈরি হয় ফিলিস্তিন ও ইসরাইল। ভারত, পাকিস্তান ও ইরান এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। কানাডা, চেকোস্লাভাকিয়া, পেরু, গুয়েতেমালা, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা ও উরুগুয়ে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার পক্ষে প্রস্তাব দেয়। মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ৫৭% ভূমি পায় ইহুদিরা। আর ৪৩% পায় ফিলিস্তিনিরা। এভাবেই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রতিষ্ঠিত হয় একটি অবৈধ রাষ্ট্র।

এ সিদ্ধান্তের পরপরই ফিলিস্তিনে নেমে আসে ইহুদিদের ভয়াবহ আগ্রাসন। এ আগ্রাসনে তিন মাসেই নিহত হয় ১৭০০ মুসলিম। দিনে দিনে বেড়ে চলে তাদের নিষ্ঠুরতা। একটি দিনের জন্যও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা। এ নির্মমতার মধ্যেই ইহুদিরা ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। রাত তখন ১২ টা ১ মিনিট। ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে ইহুদী নেতা দাভিদ বেনগুরিয়ান। এ ঘোষণার মাত্র ১০ মিনিট পর ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। তারপর স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন ও রাশিয়া। এ স্বীকৃতির ঠিক ১ ঘণ্টার মধ্যেই আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। ইহুদি সৈন্যরা ফিলিস্তিনের ৫০০ টি গ্রামের ৪০০টিই জনশূন্য করে দেয়। ইহুদি, ফরাসি আর ব্রিটিশ শক্তির কাছে সমন্বয়হীন এবং নেতৃত্বশূন্য আরবরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন দখল করে নেয় ইসরাইল। ফিলিস্তিনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়। সাত লাখ মুসলিম বাড়ি ছাড়া হয়। তারা লেবানন, সউদী আরব, মিশরসহ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন শুরু করে। আজও তারা ফিরে পায়নি তাদের বাড়ি-ঘর। সেই থেকে ফিলিস্তিনিরা আজও নিজ দেশে পরবাসী। আন্তর্জাতিক সকল রীতি-নীতি উপেক্ষা করে ইসরাইল প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে চলছে দেয়াল। চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আগ্রাসী অভিযান। অব্যাহত রেখেছে তাদের উচ্ছেদ অভিযান। জবরদখল আর নৃশংসতায় ফিলিস্তিন এখন পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর মৃত্যুকূপে। রমজান মাস আসলেই ইসরাইল মুসলিমদের উপর নৃশংসতা বাড়িয়ে দেয়। গত ১০ মে ২৬ রমজান ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উপর ব্যাপক হামলা শুরু করে। এ হামলা চলে টানা ১১ দিন। এতে প্রাণ হারায় ২৩২ জন শিশু, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ও তরুণ-তরুণী। বরাবরের মত এ হামলা ছিল এক তরফা। এক তরফা এ হামলায় ঈদের দিনেও নিহত হয়েছে ১৯ জন ফিলিস্তিনি। এর প্রতিবাদে বিশ্ববাসী শুধু নিন্দা করেছে। ঘটেছে সাময়িক যুদ্ধরিতি। এমন নিন্দা আর যুদ্ধবিরতি নতুন নয়। হামলা আর যুদ্ধবিরতির ঘটনা ১৯৪৮ সাল থেকেই চলমান। বিশ্বনেতাদের নিন্দায় ফিলিস্তিনিরা পায়না তাদের অধিকার ও প্রতিকার। মুসলিমরা কোনোদিন পায়নি সুবিচার। বিশ্বনেতারা কখনও তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করেনি। এক্ষেত্রে আরব বিশ্বের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক। ইসরাইলের বর্তমান জনসংখ্যা ৮৬ লাখ ৭১ হাজার ১০০ জন। আর ২৩ টি আরবদেশের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। এ বিশাল জনসংখ্যার নীরবতা ইসরাইলকে করে তুলেছে অধিক আগ্রাসী। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে আরব নেতাদের তেমন কোনো ভূমিকা নাই। বরং অতীত ভুলে একে একে ইসরাইলের সাথে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন মিত্রচুক্তিতে। এর বিনিময়ে মুসলিম নেতারা পেয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন পুরস্কার। এসব নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম নাম লিখিয়েছে মিশর। ১৯৬৭ সালের এক যুদ্ধে মিশর এবং জর্ডান ইসরাইলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। পরাজিত এ মিশরই ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ইসরাইলের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিনের সাথে গোপন মিটিং করেন টানা ১২ দিন। ১৯৭৮ সালে আনোয়ার সাদাতকে দেয়া হয় নোবেল পুরস্কার। আর বিনিময়স্বরূপ ১৯৭৯ সালে মিশরই সর্বপ্রথম ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর চুক্তির দৌড়ে দ্বিতীয় স্থানে এগিয়ে আসে আরেক পরাজিত আরব দেশ জর্ডান। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভবন হোয়াইট হাউসে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্থাপনে বড় ভূমিকা রাখেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর ট্রাম্প জানান, অচিরেই ইসরাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে যাচ্ছে সুদান। আর এ প্রতিযোগিতার সর্বশেষ প্রতিযোগী হচ্ছে মরক্কো। অচিরেই তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে বলে জানা যায়। এই হলো ফিলিস্তিন বিষয়ে আরববিশ্বের অবস্থান। এটাই হলো প্রাচীন মুসলিম ফিলিস্তিনের বর্তমান নির্মম বাস্তবতা। ফিলিস্তিনিদের মাটিতে জাতিসংঘ জায়গা করে দিল ইহুদিদের। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিশ্রুত রাষ্ট্রটি আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মর্যাদায় আছে ফিলিস্তিন ভূখন্ড। স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ফিলিস্তিন আজও পায়নি। ফিলিস্তিনিদের দাবী হলো, তাদের দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেয়া হোক। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের পদ দেয়া হোক। যাতে দেশটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে পারে। জাতিসংঘের নির্বাহী পদে নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে। তারা শুধু ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বন্টিত ৪৩% ভূমিটুকুই ফেরত চায়। যার সবটুকুই ইসরাইল তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। এ ভূমিটুকু ফেরত পেতে প্রয়োজন জাতিসংঘের সদিচ্ছা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ন্যূনতম ৯টি রাষ্ট্র ভোট দিলেই কেবল এই মর্যাদা অর্জন করবে ফিলিস্তিন। নিরাপত্তা পরিষদে ভোটের ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র হলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। বাকি অস্থায়ী দশটি রাষ্ট্র হলো ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, লেবানন, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়া। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মর্যাদা পেতে হলে: ১. উল্লেখিত ১৪ টি রাষ্ট্রের মধ্যে নয়টি রাষ্ট্রের ভোট পেতে হবে। ২. স্থায়ী ৫ সদস্য রাষ্ট্রের কেউ ভেটো দেবে না। ৩. নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এ প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হবে। ৪. সাধারণ পরিষদের ১৯৩ টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১২৮ টি রাষ্ট্রের সমর্থন পেতে হবে। তবেই কেবল ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। আর এ মর্যাদা পেতে দীর্ঘ ৭৩ বছর ধরে রক্ত ঝরাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনিদের এ দাবি নিরাপত্তা পরিষদে আটকে আছে ১৯৪৮ সাল থেকে। অবশ্য ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য পদ দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। আর তাতে ক্ষেপে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে সংস্থাটি। বার্ষিক ৬ কোটি ডলার তহবিল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ইউনেস্কোর বার্ষিক বাজেটের এক পঞ্চমাংশ। অথচ সদস্যপদ দেয়া বিষয়ে ইউনেস্কোতে ১৭৩ টি দেশের মধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৭টি। বিপক্ষে পড়ে ১৪ টি। ভোটদানে বিরত থাকে ৫২ টি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জার্মানি সদস্যপদের বিরোধিতা করে ভোট দেয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের দাবির সমর্থনে ভোট দেয় ব্রাজিল, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্রিটেন থাকে নিরপেক্ষ অবস্থানে। মূলত ফিলিস্তিন ইসরায়েলের উচ্ছেদ চায়না। তারা শুধু বাঁচতে চায়। ইসরাইলের উচ্ছেদ মানেই হলো ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশের উচ্ছেদ। এটা বিশ্বের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এছাড়া ইসরায়েল একটি পারমানবিক শক্তিধর দেশ। তাদের রয়েছে বোমারু বিমান, মিসাইল বোট, পেট্রোল বোট, সাবমেরিন ইত্যাদি। এর বিপরীতে ফিলিস্তিনের গুলতি, পাথর আর কিছু মাছ ধরার নৌকা ছাড়া কিছুই নেই। বিগত সাত দশকের অধিক সময় ধরে উচ্ছেদ অভিযানে নিষ্পেসিত ফিলিস্তিনিরা এখন বড়ই ক্লান্ত। আকাশপথে ঝাকে ঝাকে বোমারু বিমানের হামলা, স্থলপথে ট্যাংক, গানবোট আর কামানের গেলাবর্ষনে প্রতিনিয়ত উড়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। ভবন মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। প্রতিদিনের মিডিয়ায় আসছে ফিলিস্তিনি অবুঝ শিশুদের নিস্পাপ আর্তনাদ। অথচ ৮০০ কোটি বিশ্ববিবেক চুপচাপ। প্রতিবাদী পাথর কিংবা গুলতিটাই সরবের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বমিডিয়ায়। সেখানেই ষড়যন্ত্র আর সন্ত্রাস খুঁজে ফিরছে পশ্চিমা মিডিয়া। আর ঝাকবাঁধা বোমারু বিমান, ট্যাংক, আর কামানের হামলাকে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলছে। বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর মোট আয়তন ৫১,০০৯৮,৫২০ বর্গকিলোমিটার। স্থলভাগের আয়তন ১৪,৮৯,৫০,৩২০ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৭৭১ কোটি। ফিলিস্তিনের আয়তন ৬,০২০ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ৫১ লাখ। এতবড় বিশাল পৃথিবীতে এই সামান্য ৫১ লাখ ফিলিস্তিনের কি বাঁচবার অধিকার নাই? জাতিসংঘের কাছে প্রশ্ন, কোন কারণে ভূমিহীন-যাযাবর ইহুদিজাতিকে পরের জায়গায় অন্যায়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো? ফিলিস্তিনিদের মাটিতে কেন তাদের ভাগ দেয়া হলো? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? কারণটাকি তাহলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক নাকি ধর্মীয়? ঠিক যে কারণে অবৈধভাবে ইহুদিদের প্রতিষ্ঠিত করা হলো; ঐ একই কারণে ফিলিস্তিনিদেরও দিতে হবে তাদের বৈধ স্বাধীকার। দিতে হবে তাদের ন্যায্য স্বাধীনতা। ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখতে হবে মুসলিমবিশ্বকে। ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে আরববিশ্বকে। তাদের আন্ত:অবিশ্বাস আর অনৈক্য দূর করতে হবে। স্বজাতির করুণ আর্তনাদে দীপ্ত ও সাহসী হতে হবে। চাপ প্রয়োগ করতে হবে জাতিসংঘকে। নিশ্চিত করতে হবে স্বাধীন ফিলিস্তিনের। প্রতিষ্ঠিত করতে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা। আর এ দায়িত্ব নিতে হবে জাতিসংঘকেই।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
Email: dr.knzaman@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
যায়েদ আল মাহমুদ ৯ জুন, ২০২১, ১:০১ এএম says : 0
ফিলিস্তিনের জন্মলগ্ন থেকে আজকের পর্যন্ত সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও মোবারকবাদ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন