রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

পুড়ে গেছে শত শত ঘর

মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড অবৈধ গ্যাসলাইন থেকে আগুন ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি এর আগেও পাঁচবার পুড়েছে সাততলা বস্তি

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০২১, ১২:০০ এএম

মহাখালীর সাততলা বস্তিতে সোমবার ভোররাতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে গেছে শত শত ঘর। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। অগ্নিকান্ডে হতাহত হওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। প্রতিবার বস্তিতে আগুন লাগে, চোখের পলকে পোড়ে বস্তি। নিঃস্ব হয়ে মানুষ পথে বসে। আবার বস্তিতে ওঠে নতুন ঘর। প্রতিবারই প্রশ্ন ওঠে অবৈধ বিদ্যুৎ আর গ্যাস সংযোগ নিয়ে। কিন্তু কিছুদিন পরই সবাই তা ভুলে যায়। বরাবরের মতো সেসব বিদ্যুৎ আর গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করতে থাকনে সবাই। গতকাল সোমবার ভোরে সাততলা বস্তিতে লাগা আগুনের পরও সেই অবৈধ বিদ্যুৎ আর গ্যাস সংযোগকে দায়ী করা হয়। বলা হচ্ছে অবৈধ গ্যাসলাইন থেকে আগুনের সূত্রপাত। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এসব অবৈধ সংযোগ দিচ্ছে কারা? ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক নূর হাসান আহম্মেদকে সভাপতি করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট আগুনের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বস্তিবাসীর দাবি, অন্তত কয়েক শত ঘর পুড়ে গেছে। ঘরের আসবাবপত্র কেউ নিয়ে বের হতে পারেনি। সব পুড়ে ছাই হয়েছে। তারাও মনে করেন, আগুন অবৈধভাবে দেয়া গ্যাস লাইন থেকেই লেগেছে। তাই তারা বৈধ গ্যাস লাইনের দাবি করেন।

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার কামরুল ইসলাম বলেন, ভোর চারটার দিকে আগুনের সূত্রপাতের খবর আসে কন্ট্রলরুমে। খবর পেয়ে প্রথমে আটটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। এরপর আগুনের ভয়াবহতা বাড়ায় একে একে ১৮ ইউনিট পাঠানো হয়। ১৮ ইউনিট আড়াই ঘন্টার চেষ্টায় ছয়টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেছেন, অবৈধ গ্যাসের লাইন বা বিদ্যুতের লাইনের ত্রুটি থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। আগুনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে প্রচুর পরিমাণে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, এই দুইটার থেকে যেকোনো একটি কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ঘনবসতি এবং বেশি সেপারেশন থাকায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের আগুনের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে আগুন নেভাতে কিছুটা সময় বেশি লেগেছে। এছাড়া দাহ্য বস্তুর উপস্থিতি বেশি থাকায় আগুনটা বেশি ছড়িয়েছে।

বস্তিবাসী জানান, আগুনের সূত্রপাত বস্তির পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে। এরপর দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বস্তির উত্তর-পূর্ব দিকে। একে একে পুড়ে যায় শত শত ঘর। আগুন লাগার পর বেশিরভাগ মানুষই কিছু নিয়ে বের হতে পারেননি। সন্তান কোলে স্রেফ এক কাপড়ে বেরিয়ে যান সুরমা বেগম। তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে থাকতেন বস্তিতে। কাজ করেন পোশাক কারাখানায়।

তিনি বলেন, আগুন লাগছে ফজরের আজানের আগে আগে। আগুনের তাপে, চিৎকারে টের পাই আগুন লাগছে। এরপর বাচ্চাকে কোলে নিয়া কোনো রকম জীবন নিয়া বের হইছি। বার বার পুড়ছি। গত বছর ওই পারে ছিলাম। আগুন লাগার পর বাসা পরিবর্তন করে এই পাড়ে চলে আসি। এবার এখানেও পুড়লো সব।

মাহফুজা নামে আরেক ক্ষতিগ্রস্থ নারী বলেন, সব পুড়ে ছাড়খার। পিন্দনে যা আছে এইটুকুই শেষ সম্বল। চিপা গলি, কিচ্ছু বাঁচাইতে পারলাম না। স্বামী কোম্পানিতে চাকরি করেন, গার্মেন্টেসের নাইট গার্ড। রাতে যখন আগুন লাগে তখন তিনি ডিউটিতে। আগুনের খবরে যখন ছুটে আসে, ততক্ষণে পুড়ে সব শেষ।

জহুরা বেগম(৫০)। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সাততলা বস্তিতে বসবাস করছেন তিনি। তার স্বামী কালাম একজন রিকশাচালক। সোমবার ভোরে সর্বনাশা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার সাজানো সংসার। ঘরের ভেতরে থাকা কোনো আসবাবপত্র, টাকা পয়সা কিছুই বের করতে পারেননি তিনি। সব হারিয়ে নিঃস্ব এই বস্তির বাসিন্দা জহুরা এখন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।

জহুরা বলেন, আমাগো কপালই পুড়া। বারবার আগুনে আমরাই শেষ হই। কষ্ট কইরা সংসারের জিনিস করি আর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ পর্যন্ত তিনবার আগুনে পুরে সব ছাই হয়ে গেছে। সাততলা বস্তিতে জহুরার ১৪টি ঘর রয়েছে। ১০টি ঘর ভাড়া দিয়ে ৪টি ঘর নিয়ে থাকতেন তার পরিবার। বড় মেয়ে মদিনাকে (২২) বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলে (১৬) ইউসুফ ছোট। তাদের সঙ্গেই থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার মাদবর চরের ল²ীকান্দি গ্রামে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সাততলা বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন হজুরা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে হজুরা বলছিলেন, কিসের মধ্যে রাইন্দ (রান্না) খামু? পাতিলও পুইড়া গেছে। ঘরের ভাড়া আর স্বামীর রিকশার ইনকাম দিয়ে ফ্রিজ, টিভি খাটসব সব জিনিস করছিলাম। কিন্তু আগুনে সব ছাই হইয়া গেছে। হাতে এখন কোনো ট্যাকাও নাই যে কিছু কিন্না খামু। সকাল থেকে না খাইয়া আছি। খালি জীবনটাই আছে। সাততলা বস্তিতে হজুরার মত অনেকেই আগুনের দহনে ক্ষতিগ্রস্ত। শত শত ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেই তালিকায় রয়েছে অনেক দোকানও।

ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) বলছে, অবৈধ সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি চক্র গড়ে উঠেছে। যারা বিদুৎ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদিও এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কথা বলেনি। তবে বস্তি খালি করার জন্য অগ্নিকান্ডে প্রভাবশালী মহলেরও হাত থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আগুন নেভার ৬ ঘণ্টা পর বস্তি পরিদর্শনে আতিকেরঃ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার প্রায় ৬ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। দিয়ে গেলেন নানান আশ্বাস। গতকাল দুপুরের দিকে আগুনে পুড়ে যাওয়া বস্তির সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে এসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নগদ ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। একইসঙ্গে ঘর নির্মাণের টিন, শুকনো খাবার এবং প্রতি বেলায় রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হবে বলেও তিনি জানান।

তিনি বলেন, পুড়ে যাওয়া বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আপাতত ঘরের জন্য টিন দিতে হবে এবং এই মুহূর্তে খাদ্য লাগবে। ইতিমধ্যে কাউন্সিলর খাবার রান্নার কাজ শুরু করেছেন। প্রতিটি পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুপুর থেকে খাবার চালু হবে এবং রাতেও বস্তিবাসীদের খাওয়ানো হবে। তিনি বলেন, কড়াইল বস্তিতে বহুতলা ভবন নির্মাণ করে বাসিন্দাদের বসবাসের উপযোগী করা হবে। ক্রমান্বয়ে রাজধানীর সব বস্তিগুলোতে কাজ করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগেও পাঁচ বার পুড়েছে সাত তলা বস্তি। ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে এবং ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর এ বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই গ্যাস নয়তো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন