গণপরিবহন চালুর এক মাসের মাথায় চরম নৈরাজ্য দেখা যাচ্ছে। আসন খালি রাখার নিয়ম না মেনে প্রতিটি আসন ভর্তি করে দাঁড়ানো যাত্রীও নেয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদে যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিতে অস্বীকার করায় বেঁধে যাচ্ছে হট্টগোল, বাদানুবাদ। তাতেও ছাড় মিলছে না। ভুক্তভোগি যাত্রীরা বলেন, সব আসনে যাত্রী তুললে ৬০ শতাংশ ভাড়া অতিরিক্ত দেবো কেন? কিন্তু কে শোনে কার কথা। আবার মাস্ক ছাড়াই যাত্রী ওঠানামা করছে হরদম। এমনকি চালক, কন্ডাক্টরের মুখে মাস্কও নেই। আর জীবাণুনাশক ছিটানো সে তো কবেই বন্ধ হয়েছে। এমনতবস্থায় বর্ধিত ভাড়া বাতিলের দাবি জানিয়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।
করোনার সংক্রমণরোধে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রেখেছিল সরকার। এক মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর শর্ত দিয়ে চালু করা হয়েছিল গণপরিবহন। অর্ধেক যাত্রীবহন, চালক-সহকারী ও যাত্রীদের বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা এবং পরিবহন জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করার শর্ত দেয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। এক মাস যেতে না যেতেই আবার সেই নৈরাজ্যের চিত্র। রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও যাত্রী নেয়া হচ্ছে ইচ্ছামতো। কোনো কোনো বাসে দেখা যাচ্ছে সব আসন ভরেই যাত্রী নেয়া হচ্ছে। বাড়তি যাত্রী নেয়া হচ্ছে দাঁড়িয়ে। এ ছাড়া মাস্ক পরছেন না অনেক যাত্রী। কন্ডাক্টর, হেলপার ও চালকেরও একই অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও বাড়তি ভাড়া আদায়ে কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে না। বরং ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়ার স্থলে দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে কোনো কোনো রুটে।
এদিকে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ী চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ২ জুন বুধবার বিকালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অফিসে কেন্দ্রীয় মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও ঢাকাস্থ পরিবহন কোম্পানীগুলোর চেয়ারম্যান/এমডি’দের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব জনাব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। সভায় উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি মফিজুল হক বেপু, সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা ও নগর বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল কালাম, মহাখালী বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব মো. আবুল কালামসহ আরো অনেক মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। সভায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ী চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ে ঢাকায় ৮টি ‘ মোবাইল টিম’ গঠন করা হয়। সভা শেষে জানানো হয়, মালিক-শ্রমিক ও বিআরটিএ’র ম্যাজিস্ট্রেট এর সমন্বয়ে এই টিমগুলো ৩ জুন হতে ঢাকা শহরের নির্ধারিত ৮টি স্থানে কাজ শুরু করবে। ৫ই জুন শনিবার থেকে পূনরায় এই অভিযান চলমান থাকবে। চলমান এ অভিযানের মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার নগরীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, মিটফোর্ড, বাবু বাজার এলাকায় চলাচলরত বাসগুলোতে কোনো নিয়ম মানতে দেখা যায় নি। বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার, চালকের মুখের মাস্ক থুতনির নিচে ঝুলতে দেখা গেছে। সকালে বৃষ্টির মধ্যে বাসগুলোতে সব আসন ভর্তি করে যাত্রী নিতে দেখা গেছে। পুরান ঢাকার মিডফোর্ট ও বাবু বাজার এলাকায় দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জগামী সব হিউম্যান হলার ও টেম্পুতে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হচ্ছে। যাত্রী, চালক হেলপার কারো মুখে মাস্ক নেই। সিএনজি অটোরিকশাগুলোতেও ডেকে ডেকে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হচ্ছে। বাসেরও একই অবস্থা।
একই দৃশ্য দেখা গেছে শনিরআখড়াতেও। চিটাগাং রোড থেকে কমল বাসে করে গুলিস্তান যাচ্ছিলেন যাত্রী রহমান। তিনি জানান, আগে চিটাগাং রোড থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। বাসে কোনো আসনই খালি রাখা হচ্ছে না। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া কেনো দেবো এ প্রশ্ন করতেই কন্ডাক্টর রেগে ওঠে। বেশ কয়েকজন যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে এমন প্রশ্ন করায় কয়েক দফা ঝগড়া হয়েছে, প্রতিদিনই হয়। সেফায়েত নামে একজন যাত্রী বর্ধিত ভাড়া বাতিলের দাবি করে বলেন, সরকার কোনো কালেও বাস মালিক-শ্রমিকদের নিয়ম মানাতে পারেনি। এরা মানবেও না। সুতরাং বর্ধিত ভাড়া বাতিল করুক। করোনার দোহাই দিয়ে আমাদের গলা কেনো কাটা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও বাসস্ট্যান্ড ঘুরে একই চিত্র দেখা গেছে।
গণপরিবহনের মধ্যে শুধুমাত্র ট্রেনে আসন ফাঁকা রেখে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী যাত্রী পরিবহন করলেও লঞ্চ এবং দূরপাল্লার বাসেও অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। অতিরিক্ত যাত্রী কেন নিচ্ছেন জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থেকে গাজীপুরগামী বলাকা বাসের কন্ডাক্টর জানান, সামনে অনেকে নেমে যাবে। তখন সিট খালি হবে। তিনি দাবি করেন, যাত্রীরা আসন ফাঁকা রাখতে চায় না।
ধানমণ্ডি এলাকায় বিআরটিসি বাসের যাত্রী ফারুক জানান, মিরপুর গোলচত্ত্বর থেকে সকালে অফিসের কাজে মতিঝিল এসেছিলেন। বাসের মধ্যে অতিরিক্ত বেশ কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিল। বাসটিতেও ছিল না কোনো স্যানিটাইজারেরও ব্যবস্থা। তবে এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি তিনি। কারণ হিসেবে জানান, সড়কে পরিবহন সংকট। বাধ্য হয়েই যাত্রীরা বাসে উঠছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও করোনার অজুহাতে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণ। কৌশল হিসেবে বাসের সামনে কয়েক সিটের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী বসানোর কৌশলও অবলম্বন করছেন কেউ কেউ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যে উদ্দেশ্য গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে তার বিনিময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা গণপরিবহন চালাবে। অর্ধেক যাত্রী বহন করবে। সরকারের এমনই নির্দেশনা ছিল। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে ভিন্নচিত্র। অতিরিক্ত যাত্রীর পাশাপাশি দ্বিগুণ ভাড়াও নেয়া হচ্ছে। আমরা মনে করি যাত্রী সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই প্রতারণা বন্ধ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন