রাজধানীর গণপরিবহনে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছেই। সিটিং সার্ভিস, গেটলক, সময় নিয়ন্ত্রণ, স্পেশাল সার্ভিসসহ নানা নামে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। কোনো নিয়ম কিংবা সরকারের কোনো নির্দেশও পরিবহন মালিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। এদের কাছে মন্ত্রী থেকে শুরু করে নীতি-নির্ধারকরাও রীতিমতো অসহায়। পরিবহন মালিকদের চাপের মুখে সরকারকেও সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করতে দেখা যায়। এসব অনিয়ম ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলেই পরিবহন মালিকরা রাজধানীজুড়ে বাসের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলে দেয়। সরকার তখন যাত্রীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
নগরীতে প্রতিটি বাসেই যাত্রী নেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ, ভাড়াও নিচ্ছে বেশি। প্রতিটি রুটেই আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না। হ্যান্ড-স্যানিটাইজার তো দূরের কথা মাস্কও পরছেন না চালক-হেলপাররা। যাত্রীরাও মাস্ক ছাড়াই অবাধে যাতায়াত করছেন। দুই সিটে বসিয়ে যাত্রী নেওয়ার পরও দাঁড়িয়েও যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত বাগবিতন্ডা হচ্ছে।
লকডাউন শিথিলের পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের ঘোষণা দেয় সরকার। এক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। এরপর এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গত ১১ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিটপূর্ণ করে যাত্রী নিয়ে বাসচলাচলের নির্দেশ প্রদান করা হয়। কিন্তু সরকারের সেই নির্দেশনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। নগরীর একাধিক ট্রাফিক পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, গণপরিবহনে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিত। নির্দেশনা অমান্য করে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হচ্ছে এবং ৬০ শতাংশের পরিবর্তে ১০০ শতাংশেরও বেশি ভাড়া হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি সড়কে রয়েছে এমন চিত্র। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা।
ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত গণপরিবহনে যাত্রী ভাড়া কার্যকর ও রুট পারমিট দেয়ার দায়িত্ব রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির (আরটিসি) হলেও সেই সংস্থাই বর্তমানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। মোটরযান আইন-১৯৮৩ অনুযায়ী রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের গায়ে আঁচড় থাকতে পারবে না, যানবাহন রংচটা হতে পারবে না, সিট ভাঙা থাকতে পারবে না এবং যান্ত্রিক ত্রæটিমুক্ত হতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ওই যানবাহনকে ফিটনেসবিহীন হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এসব ত্রæটি সারিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। অথচ এসব নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই ফিটনেসবিহীন ও ত্রæটিযুক্ত গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গণপরিবহনের রুট পারমিট নিতে হয়। একটি বাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলবে, নাকি বিশেষ সার্ভিস হিসেবে চলবে তা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেয়। মহিলা বাস সার্ভিস ছাড়া ঢাকায় বিশেষ সার্ভিস বলতে কোনো সার্ভিস নেই। গণপরিবহনের রুটের কোন স্থানের ভাড়া কত হবে, সেটা সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের নির্ধারিত ভাড়া কিছুদিন পরই অকার্যকর হয়ে যায়। হঠাৎ করেই পরিবহন কোম্পানিগুলো ‘সিটিং সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ভাড়া ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। ভাড়া বাড়ানোর পর দাঁড়িয়ে কোনো যাত্রী নেয়া হয় না। মোহাম্মদপুর থেকে গুলিস্তান ও মতিঝিলের ভাড়া এক মাস আগেও ১৫ টাকা ছিল। হঠাৎ করে এই রুটে চলাচলরত পরিবহন কোম্পানিগুলো সিটিং সার্ভিস, ডাইরেক্ট সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিস ইত্যাদি নাম দিয়ে ভাড়া ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ৫ টাকার ভাড়া ১০ টাকা এবং ১৫ টাকার ভাড়া ২০ থেকে ২৫ টাকায় টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মিরপুর রুটের কয়েকটি পরিবহন কোম্পানিও একইভাবে ২০ টাকার ভাড়া ২৫ টাকা ও ২৫ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আব্দুল্লাহপুর ও এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তান, মতিঝিলে আসা বাসের ভাড়াও অনুরূপভাবে বেড়েছে।
রাজধানীতে মিডওয়ের কোম্পানির বাসগুলো আগে লোকাল হিসেবে চলত। কিন্তু হঠাৎ করেই এই কোম্পানির সব বাস এখন সিটিং সার্ভিস হিসেবে চালানো হচ্ছে। প্রথম কয়েকদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত এবং বিকালে অফিস ছুটির পর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দাঁড়ানো অবস্থায় যাত্রী পরিবহন না করলেও এক সপ্তাহ পরই এই নিয়ম পাল্টে যায়। বর্ধিত ভাড়াতেই দাঁড়ানো অবস্থায় যাত্রী পরিবহন করে লোকাল বাস হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এভাবেই চলতে থাকে। গেটলক বা সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই এই বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে বাস-কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে যাত্রীদের শুরু হয় কথা কাটাকাটি, এমনকি কখনো তা হাতাহাতি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। রাজধানীতে এরকম আরও বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে যেমন- বাহন, ট্রান্সসিলভা, রাইদা, সুপ্রভাত ইত্যাদি।
ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি বা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা পরিবহন কোম্পানিগুলো করছে না। রান্তায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের কাছে এই অনিয়মের ব্যাপারে যাত্রীরা অভিযোগ করলেও ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এভাবে সিটিং ও গেটলকের নামে বাস চলাচলের কারণে সব রুটের যাত্রীরা এখন চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নগরীর ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, পল্টন ও কারওয়ানবাজার এলাকায় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। সকালের দিকে এসব স্থানে অফিসগামী যাত্রীদের প্রচন্ড ভিড় থাকে। আবার বিকালে অফিস ছুটির পরও প্রচন্ড ভিড় দেখা যায়। তখন বাসগুলো ইচ্ছে মতো যাত্রী নিলেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়।
শরিফুল ইসলাম নামের এক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গণপরিবহন কোম্পানিগুলো সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সার্ভিসের নামে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। যাত্রীদের কাছ থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। অথচ এই নৈরাজ্য দেখার কেউ নেই। প্রতিবাদ করলে উল্টো হেনস্থার শিকার হতে হয়। সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিলেও নগর পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপারে উদাসীন। এ কারণেই এই সেক্টরে নৈরাজ্য বাড়ছে। আহাদুজ্জামান নামের অপর এক যাত্রী বলেন, সরকার সমর্থক লোকজন পরিবহনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়ালেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অপরদিকে পরিবহন মালিক ও পরিবহন সংগঠনের নেতারা দাবি করেছেন, নগর পরিবহনে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে পরিবহন কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো সার্ভিস চালাচ্ছে। এভাবে সার্ভিস পরিচালনার বিষয়ে পরিবহন সংগঠনগুলোও অনেক সময় অবহিত থাকে না।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা একটি বড় মেগা সিটি। এ শহরে জনসংখ্যার চাপও অসম্ভব। এ ধরনের একটি শহরের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার লেশমাত্রও দেখা যাচ্ছে না। আমরা অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাকে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন করে ঢেলে সাজালে দুর্ভোগ কমে আসবে। একই সঙ্গে বাড়াতে হবে গণপরিবহন। এজন্য বেসরকারি সেক্টরের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা বিআরটিসিকেও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, করোনা মহামারিতে সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে বেকার। সংসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো অবস্থা। অবিলম্বে এই বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করার দাবি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন