গত বছর জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুই দিনের বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশার কথা শোনা গিয়েছিল। মোদি ঢাকায় এসেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা ও সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। তবে তিস্তার পানি বন্টন বিষয়ে তেমন আশাপ্রদ কিছু বলেননি, আবার আশাহতও করেননি। ভবিষ্যতের আশাবাদের কথা বলে তিনি ভারতের সত্তর বছরের কাক্সিক্ষত ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা আদায় করে যান। ভারত-বাংলাদেশের মিডিয়া ও সরকারি নথিপত্রে একে ট্রানজিট নামে অভিহিত করা হলেও ভারতের মূল ভূ-খ- থেকে মালামাল নিয়ে বাংলাদেশের বন্দর ও সড়ক অবকাঠামো ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের রাজ্যগুলোতে নিয়ে যাওয়ার এই দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থা আসলে ‘করিডর’ হিসেবে গণ্য। ট্রানজিট-করিডর বাস্তবায়নের আগে এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের শত শত কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনার কথা শোনানো হয়েছিল। প্রথমে পরীক্ষামূলক ও বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বিনামূল্যে ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট রুট চালুর এক বছর পর লাভের অঙ্ক খুবই হতাশাজনক। যেখানে ট্রান্সশিপমেন্টে প্রতিটন পণ্য পরিবহনে ভারতের আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে কমপক্ষে ১০০ ডলার (প্রায় ৮ হাজার টাকা) এবং সময় লাগছে ৩০ দিনের স্থলে ১০ দিনেরও কম, পাশাপাশি বিপদসঙ্কুল দীর্ঘ পথের ঝক্কি-ঝামেলাও অনেক কমেছে। সেখানে প্রতিটন ভারতীয় পণ্যের ট্রানজিট ফি নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১৯২ টাকা। ট্রানজিটের ফি নির্ধারণের জন্য গঠিত কোর কমিটি সবদিক বিবেচনা করে ১০৫৮ টাকা ফি নির্ধারণের সুপারিশ করার পরও কীভাবে তা ১৯২ টাকায় নেমে এলো দেশের মানুষ তার কিছুই জানে না। অথচ দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে ট্রানজিট উপযোগী করে তুলতে এ খাতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো ও বন্দর এখনো ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের উপযোগী নয়। ইতিমধ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশের সড়ক ও অবকাঠামো খাতে প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেই মহামূল্য অবকাঠামো ভারতীয় ট্রানজিটের বিশালাকৃতির ট্রাক, ট্রেইলার ও কভার্ড ভ্যানের চাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পাচ্ছে না। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় ভারতীয় ট্রানজিটের নামে ভারতীয় করিডর বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি। বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং গঙ্গা ও তিস্তার পানি বন্টনের মতো ইস্যুগুলোকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ভারতের জন্য করিডর উন্মুক্ত করে দিলেও বছরের পর বছর ধরে ধর্না দিয়েও বাংলাদেশ কিছুই পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক নদীর উপর ভারতের একতরফা নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে একদিকে বাংলাদেশের বিশাল অংশ মরুভূমি হতে চলেছে। অন্যদিকে উজানে বাঁধ দিয়ে আটকে দেয়ার কারণে পলি জমে নদীগুলোতে পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আবার অকস্মাৎ ফারাক্কা ও গজলডোবা বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে। বন্যা ও নদীভাঙনে প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল ও অবকাঠামোর ক্ষতি হচ্ছে। অববাহিকাভিত্তিক নদীব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হলে বাংলাদেশকে এ ধরনের সাংবাৎসরিক বিড়ম্বনা ও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো না। জনমত ও রাজনৈতিক চাপের কারণে ভারত সরকার অনেক ন্যায্য অধিকার থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করলেও ভারতের স্বার্থের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার জনমতের কোনো তোয়াক্কা করছে না। বিশেষত: তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে ভারতীয় টালবাহানায় বাংলাদেশ সরকারের যেন কিছুই করণীয় নেই।
গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই মহাজোট সরকার তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির জন্য ভারতের প্রতি চাপ সৃষ্টি করলেও যতই দিন যাচ্ছে তিস্তার পানি বন্টনের প্রত্যাশা ক্রমে দুরাশায় পরিণত হচ্ছে। অথচ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের আগে ২০১১ সালেই তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি চূড়ান্ত এবং সময়ের ব্যাপার বলে অভিহিত করা হয়েছিল। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ভারত-বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের মুখে দুই প্রতিবেশী দেশের ‘বন্ধুত্ব’ সম্পর্কে অনেক রেটরিক শোনা গেলেও ভারতীয় অনিচ্ছা ও অনাগ্রহের কারণে প্রায় ৬ বছর ধরে যৌথ নদী কমিশনের কোনো বৈঠক হচ্ছে না। পানিপ্রবাহ রুদ্ধ করে নদীগুলোকে হত্যা করার পর নদী কমিশনের বৈঠক কোনো কাজে আসবে না। সংশ্লিষ্টরাও হয়তো এটা ভালো করেই জানেন। যখন-তখন ভারতীয় পক্ষের আবেদন-আবদারে বাংলাদেশ তার সীমান্ত, করিডর, বাণিজ্য ও নিরাপত্তার সবকিছু উদারহস্তে উন্মুক্ত করে দিলেও বাংলাদেশকে শুকিয়ে ও পানিতে ডুবিয়ে মারার তৎপরতা কখনো বন্ধ হয়নি। সাম্প্রতিক বন্যায় বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির পেছনে ভারতের দায় রয়েছে। এমনকি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর পক্ষ থেকেও ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়ার দাবি তোলা হচ্ছে। তবে বন্যার অজুহাতে গত মাসে সম্পাদিত এক সমঝোতা স্মারকের আওতায় আসাম ও ত্রিপুরায় প্রতিদিন শত শত জ্বালানিবাহী ট্রেইলার ও খাদ্যসামগ্রী যাতায়াতের সুযোগ পাচ্ছে বিনাশুল্কে। সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা ভারতের সাথে বর্তমান ট্রানজিট ব্যবস্থাকে অস্বচ্ছ এবং বাংলাদেশের জন্য সহায়ক বা ইতিবাচক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। ইইউ প্রটোকলসহ বিশ্বের অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ট্রানজিট রুটের অনুরূপ বিদ্যমান সারচার্জ, দূষণচার্জ, রক্ষণাবেক্ষণ চার্জসহ ট্রানজিট ফি নির্ধারণের পদক্ষেপ নিতে হবে। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার স্বার্থেই যৌথনদীর পানিবন্টনসহ ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের অনুকূলে আনতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন