দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকারি বিধি-নিষেধ অনুযায়ী পর্যটন কেন্দ্র এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকার হোটেল-মোটেল বন্ধ রাখার কথা থাকলেও কক্সবাজারের তারকামানের হোটেলগুলো তা মানছে না। এতে করে ঠেকানো যাচ্ছে না সংক্রমণ। প্রাপ্ত তথ্যমতে এপ্রিল মে জুনে কক্সবাজারে বেড়েছে সংক্রমণ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত স্বাভাবিক করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে পর্যটনখাত। বিশেষজ্ঞদের মতে পর্যটনখাত খুলে দিলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে ঝুঁকি এড়াতে সরকারিভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে পর্যটন খাত। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব হেলাল উদ্দিন আহমদ জানান, সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এখনই পর্যটন খাত খুলে দেয়া যাচ্ছে না।
এদিকে গণপরিবহন চালু হওয়ার পর কক্সবাজারে ভিড় জমাতে শুরু করেছে পর্যটকরা। ইতোমধ্যে ছুটি শেষে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কক্সবাজার আসতে শুরু করেন এনজিও কর্মকর্তারাও। ছোটখাট হোটেলগুলো প্রশাসনের নজরদারিতে বন্ধ থাকলেও মাঝারি ও তারকামানের হোটেলগুলো ব্যবহার করছেন পর্যটক ও এনজিও প্রতিনিধিরা। হোটেল সাইমন রিসোর্ট, হোটেল রয়েল টিউলিপ, হোটেল লং বিচসহ আরো বেশ কিছু তারকা মানের হোটেল খোলা রয়েছে বলে জানা গেছে। এতে করে কক্সবাজারে করোনা সংক্রমণ কমছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন অফিসের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. সাকিয়া হক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ১৫ মাসে কক্সবাজারে মোট করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১১ হাজার ২২৬ জন। একই সময়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ১১৮ জন। এর মধ্যে ১৯ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং ৯৯ জন স্থানীয় নাগরিক। তথ্যমতে মোট আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার ১.০৬%।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে সদর উপজেলা ৪ হাজার ৭৬২ রোগী নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। এটি জেলার মোট আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৪৩%। এখানে সংক্রমণ বেশি হওয়ার পেছনে পর্যটক ও এনজিও কর্মীদের অবাধ বিচরণকেই কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
সংক্রমণের দিক থেকে ১ হাজার ২৮৫ রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ মোট ২ হাজার ৬৮২ করোনা রোগী নিয়ে উখিয়া রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। এর মধ্যে স্থানীয় নাগরিক ১ হাজার ৩৯৭ জন। ২৫০ রোহিঙ্গাসহ মোট ১ হাজার ৫৩৫ করোনা রোগী নিয়ে টেকনাফ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এখানে স্থানীয় নাগরিক ১ হাজার ২৮৫ জন। এই পরিস্থিতির কারণে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় স্থানীয়ভাবে লকডাউন কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে।
এছাড়াও ৭৯২ জন করোনা রোগী নিয়ে চকরিয়া রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে। ৬৭১ জন করোনা রোগী নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে রামু। ৬৫৪ রোগী নিয়ে মহেশখালী ষষ্ঠ অবস্থানে। ২৯৯ জন রোগী নিয়ে পেকুয়া সপ্তম অবস্থানে। ১১০ জন করোনা রোগী নিয়ে কুতুবদিয়া রয়েছে অষ্টম অবস্থানে।
কক্সবাজার আরআরআরসি অফিসের স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, ১ হাজার ৫৩৫ রোহিঙ্গা শরণার্থীর শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১ হাজার ২৮৫ জন এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ২৫০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৯ জন রোহিঙ্গা মারা গেছেন। তবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিল- মে-জুন মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আক্রান্তের হার অনেক গুণ বেড়েছে।
মেডিকেল অফিসার ডা. সাকিয়া হকের দেয়া তথ্যমতে, কক্সবাজার জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ১০ হাজার ৬৪ জন সুস্থ হয়েছেন। তবে আক্রান্তের তুলনায় সুস্থতার হার ৯০% বলে জানা গেছে।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে এই উদ্বেগজনক অবস্থার পরেও কোন বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে হোটেলগুলো অবাধে ভাড়া দিচ্ছেন অতিথিদের। অনলাইনে বিশেষ আকর্ষণীয় ছাড়েরও দেখা মিলছে এইসব হোটেলগুলোর। তবে তারকা মানের হোটেলগুলো অবাধে ব্যবসা করলেও বন্ধ রাখতে হচ্ছে ছোট হোটেলগুলো। কক্সবাজারের একটি হোটেলের কর্মকর্তা জানান, বড় হোটেলগুলো খোলা রাখলেও আমরা খুলতে পারি না। আমরা খুললেই ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করে। এই ভয়ে আমরা হোটেলগুলো খুলতে পারছি না।
ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, কক্সবাজারে আগত পর্যটকরা তাদের আত্মীয়দের বাসায় উঠছে। তবে বড় হোটেলগুলো বিদেশি এনজিও কর্মকর্তাদের রাখার শর্তে কিছুটা খোলা রাখলেও সেখানে কিছু দেশীয় পর্যটকদের রাখছেন। কিন্তু ছোট হোটেলগুলো একেবারে বন্ধ রাখা হয়েছে।
কলাতলিসহ পর্যটন জোন সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিচে পর্যটকদের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন স্পটে অবাধ বিচরণ করছেন পর্যটকরা। এ ব্যাপারে পর্যটন ও প্রটোকল শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুরাদ হাসান জানান, সংক্রমণ রোধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তবে তারকা মানের হোটেলগুলোতে মাসিক ভিত্তিতে এনজিওর কর্মকর্তারা আছেন বলে আমরা জানি। যদি তারা সাধারণ পর্যটক রাখেন ডিসির সাথে কথা বলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
কক্সবাজারে যেসব গাড়িগুলো আসছে তাদের ক্ষেত্রে কোন নির্দেশনা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সব সময় তাদেরকে নিরুৎসাহিত করে আসছি কিন্তু তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, এনজিও বা জরুরি কাজে কক্সবাজার যাচ্ছি। তখন তো আর কিছু বলার থাকে না।
স্থানীয়দের মতে, পর্যটকদের কক্সবাজার ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা না গেলে কক্সবাজারে সংক্রমণ বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে না। সেক্ষেত্রে তারাকা মানের হোটেলগুলোকেও বিধি নিষেধের আওতায় আনা দরকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন