ভূমিকম্প সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, জানাতে হবে নিজের প্রয়োজনে, সমাজের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শক্তিশালী ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকায় ১০ ভাগ ভবন ধসে যেতে পারে, প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে ২ লাখ মানুষের। ভূমিকম্প কবে হবে না হবে, সে জন্য ভবন নির্মাতারা টাকা খরচ করতে নারাজ। সাধারণত একটি ভবন নির্মাণে যেখানে ২০ কোটি টাকা খরচ, সেখানে ভবন ও ফ্লাট মালিকরা সৌন্দর্য বর্ধনে ২৫ কোটি টাকা খরচ করতে রাজি। এছাড়া কেউ কেউতো নিজের ফ্লাটের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে কোটি টাকা খরচ করে থাকেন। অথচ, ভবনের ত্রুটি বা ভূমিকম্প সহনীয় ব্যবস্থাপনা সংশোধনে মাত্র ২০ লাখ টাকা খরচ করতে চান না। স্থপতি ও কাঠামো প্রকৌশলীরা বলেন, নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে আরসি ব্রেসিং বা সিয়ার ওয়াল বা উইং ওয়াল সঠিকভাবে নির্মাণ করলে অনেক কম খরচে ত্রুটিমুক্ত ভবন নির্মাণ সম্ভব। ভ‚মিকম্প খুব বেশি হলে এক থেকে দেড় মিনিট। বড় ধরনের ভ‚মিকম্প হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যা ঘটার তা ঘটে যায়। বহুতল ভবনে অবস্থান করলে এত অল্প সময়ে তাড়াহুড়ো করে নামলে কেউই বাইরে বের হতে পারবে না। তখন বিমের নিচে দাঁড়ানো না দেওয়ালের পাশে দাঁড়ানো, সে চিন্তার চেয়েও অবকাঠামো মজবুত করার সাথে শুধু সৌন্দর্য বর্ধনে নয় সুরক্ষায় ভবনের ব্যয় বাড়ানো যে জরুরি, তা বুঝতে হবে।
সম্প্রতি কয়েক দিনের ব্যবধানে সিলেট অঞ্চলে সিরিজ ভূমিকম্প মানুষের মনে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অঞ্চলে ভূমিকম্প আতঙ্ক থাকলেও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। যদিও গণমাধ্যমে ইতিপূর্বে সংবাদ বেরিয়েছে সিলেটে জলাশয় ভরাট ও পাহাড়-টিলা কাটা চলছে হরহামেশা। কোনো নিয়মনীতি বা বিল্ডিং কোড না মেনেই গড়ে উঠছে একের পর এক বহুতল ভবন, অট্টালিকা। টানা ভূকম্পন বড় ভূমিকম্পের আভাস। সিলেটের ঘটনায় কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দেশের নাগরিক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের। ঘন ঘন ভূকম্পন কেবল অস্বাভাবিকই নয় অশনিসংকেতও। একই সঙ্গে এটি আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতিরও বার্তাবাহক। অতএব, ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের দেশে ব্যাপক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে সব ভবনের ভ‚মিকম্প প্রতিরোধ সার্টিফিকেট দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ভূমিকম্পই একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার কোনো পূর্বাভাস নেই। মানুষ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না, সেটাই মানুষের সীমাবদ্ধতা। তবে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। পূর্বপ্রস্তুতি হতে পারে ভূমিকম্প মোকাবিলার একমাত্র পন্থা। দুর্যোগকালীন সময়ে না ঘাবড়ে, সচেতনভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমেই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। অতিরিক্ত মাটি কর্ষণ করলে, পরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ না করলে, বিল্ডিং কোড মেনে না চললে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্পের ঝুঁকি ভেদে বাংলাদেশকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে সিলেট সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তথা প্রথম বলয়ে রয়েছে। ভূঅভ্যন্তরে শিলায় যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বছর আগের এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেটে এক লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ ভাগ ৬ তলা বা তার চেয়ে বেশি। তবে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে হোল্ডিংই আছে ৭০ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এ অঞ্চলের প্রায় ৮০ ভাগ স্থাপনা ধসে পড়তে পারে। এতে প্রাণ হারাবে প্রায় ১২ লাখ মানুষ; ক্ষতি হবে ১৭ হাজার কোটি টাকার।
বাংলাদেশ বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর একটি। এর সাথে রয়েছে ব্যাপক হারে অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ। শহরাঞ্চলের বেশির ভাগ অবকাঠামোই ভূমিকম্প অসহনীয় হওয়ায় আমাদের বিপদের মাত্রা সব সময়ই বহু গুণ বাড়তি। অন্যান্য দুর্যোগ অপেক্ষা অনেকটাই ভিন্নতর ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের দেশের সক্ষমতা এখনো বলার মতো পর্যায়ে নেই। আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি রয়েছে পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবলের ঘাটতি।
১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটা ভ‚কম্পনের ইতিহাসে ‘দ্য গ্রেট আসাম আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। রিখটার স্কেলে যা ছিল প্রায় ৮ মাত্রার। ১৯৫০ সালে অসামে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণে সিলেট অঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ছিল। ওই ভূমিকম্পটি ‘আসাম-তিব্বত আর্থকোয়েক’ নামে ইতিহাসে পরিচিত। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৬। ১৮৯৭-এর ভূমিকম্পটি যদি আবার ঘটে, তবে কী হবে? সেবার ঢাকা কেঁপেছিল মডিফাইড মার্সিলি ইনটেনসিটি (এমএমআই) স্কেলের রোমান ৭-এর অধিক তীব্রতায়। তখন পাকা দালান এবং জনসংখ্যা খুব কম থাকায় ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহত হয়েছিল খুবই কম। আজকের ২০ কোটির বাংলাদেশে হলে কী অবস্থা হবে?
২০১৬ সালে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার জিওসায়েন্সে এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে একটি সুবিশাল চ্যুতির (ফল্ট) অবস্থানের কারণে ভূগর্ভে যে শক্তি জমা হয়েছে, তাতে সিলেট অঞ্চলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুতের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একটি দল ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক যুক্ত ছিলেন।
দুর্বল অবকাঠামো, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রয়োজনীয় বিল্ডিং কোড মেনে না চলার কারণে এবং যত্রতত্র ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। দেশের সীমান্তের পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হওয়ার দরুন আমাদের বিপদের মাত্রা সব সময়ই বহু গুণ বাড়তি। পৃথিবীর যে ছয়টি অঞ্চলকে ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিকপূর্ণ মনে করা হয় তার একটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। সিলেট থেকে বেশি দূরে নয় এ অঞ্চল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঝুঁকিপূর্ণ কতিপয় ভবন ভেঙে না ফেলে রেকটিফাইটিং করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে ভবনগুলোকে গড়ে তোলা যেতে পারে। দেশে যে হারে ত্রুটিপূর্ণ নকশায় পাকা ভবন, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে ভ‚মিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে অস্বাভাবিক। তাই আইন মেনে ভবন নির্মাণে সচেষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষকেও এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন