বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাসযোগ্য ঢাকা নিশ্চিত করতে হবে

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০২১, ১২:০২ এএম

ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, দেশের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক শহর। অথচ, বাসযোগ্য শহরের তালিকায় বিশ্বে এই শহরের স্থান ১৩৭তম। লন্ডন ভিত্তিক সংগঠন ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক গত ৯ জুন প্রকাশিত ২০২১ সালের বিশ্বের সেরা ১৪০টি বাসযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড শহর, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে জাপানের ওসাকা শহর এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহর। এই তালিকায় আমাদের ঢাকা শহরের অবস্থান ১৩৭তম, তালিকার ১৪০তম স্থান অধিকার করেছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। তবে এই সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৯ সালের রিপোর্টে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৮তম। সেই হিসাবে বিগত দুই বছরে আমাদের অবস্থান এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। তবে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় আমাদের অবস্থান আরো উন্নত হতে হবে এবং আমাদের সুন্দর জীবনের স্বার্থেই সেটা করতে হবে। তার জন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। ঢাকা শহরে অনেকগুলো সমস্যা থাকলেও প্রধান সমস্যা হচ্ছে যানজট এবং জলজট।

যানজট ঢাকা শহরের একটি প্রধান সমস্যা। প্রতিদিনই রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। যেদিকেই যান না কেন যানজট আছেই। কোথাও যাবার জন্য বের হয়েছেন, অথচ, যানজটের কবলে পরে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট হয়নি, এরকম কোনো রেকর্ড নেই। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, যানজটে বছরে ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা আর প্রতিদিনই নষ্ট হচ্ছে ৩২ লক্ষ কর্মঘণ্টা। সংস্থাটির মতে, তীব্র যানজটের কারণে ঢাকার রাস্তায় গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় গড়ে ৭ কিলোমিটার এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার। ২০১৭ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেছেন, ১০ বছর আগেও ঢাকায় যানবাহনের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার এবং যেটা এখন ঘণ্টায় ৭ কিলোমিটার। কিন্তু এভাবে তো একটি শহর চলতে পারে না। এভাবে যানজট নিয়ে কোনো শহর টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং, এই ঢাকা শহরকে উন্নত করতে হবে এবং তার জন্য এই মুহূর্তেই বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকার এই যানজট থেকে ঢাকাকে মুক্ত করতে বেশ কিছু ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে এবং আরো অনেকগুলো নির্মাণাধীন। তাছাড়া, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস এবং মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যানজট অনেকটা কমে আসবে। তবে এসব প্রকল্পের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বেশ কিছু ক্রস পয়েন্টে ওভার পাস নির্মাণ করতে হবে। ক্রস পয়েন্টে ওভার পাস নির্মাণ হলে ঢাকার যানজট অনেকটাই লাঘব হবে।

অতিরিক্ত জনসংখ্যাই ঢাকা শহরের অন্যতম একটি সমস্যা। বিশ^ব্যাংকের হিসাব মতে, ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। আর ২০৩৫ সালে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি হবে। জনসংখ্যার কারণে ঢাকা একটি ওভার লোডেড শহরে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যান্য শহরে জনগণের নাগরিক সুবিধা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকার কারণে প্রতিদিনই স্রোতের মতো মানুষ ঢাকা শহরে বসবাসের জন্য প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৯,৪৯,৫৯০টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছে ২,৬১,৭০৫টি ইউনিট। সংস্থাটির হিসাবে শিল্প-কর্মসংস্থানের ৪৫ শতাংশই ঢাকায়। তাই স্বাভাবিক কারণেই ঢাকায় জনসংখ্যা বেশি, আবাসিক সংকট বেশি এবং পরিবহন সংকটও বেশি। তাছাড়া প্রশাসনিক কর্মকান্ডের সকল দপ্তরের হেড অফিস ঢাকায় হওয়ার কারণে মানুষকে বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। ফলে ঢাকার জনসংখ্যা কেবল বাড়ছেই। ফলে ঢাকা শহরে যানজটও বাড়ছে। কারণ, এতগুলো মানুষের চলাচলের জন্য যে পরিমাণ যানবাহনের প্রয়োজন এবং সেই যানবাহনসমূহ সুষ্ঠভাবে চলাচলের জন্য যে ধরনের রাস্তা দরকার তা কিন্তু ঢাকা শহরে নাই। ফলে নিয়মিতভাবেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমেই ঢাকা শহরের ওপর মানুষের অব্যাহত চাপ কমাতে হবে। তার জন্য ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ঢাকার মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। ঢাকা শহরে অবস্থিত শিল্প-কারখানাসমূহ বিশেষ করে গার্মেন্টসসমূহ শহরের বাইরে স্থানান্তর করতে হবে। এর জন্য ঢাকার বাইরে উপযুক্ত স্থানে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির সরবরাহ নিশ্চিত করে যতগুলো সম্ভব ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন করতে হবে এবং সেসব স্থানেই ঢাকা শহরের শিল্পকারখানাসমূহ সরিয়ে নিতে হবে এবং নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে। এর মাধ্যমে ঢাকা শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ যেমন কমবে, ঠিক তেমনি কারখানায় লোকজনের যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহনের জন্য যে সমস্ত গাড়ি ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে চলাচল করে তাও কমে আসবে। ফলে ঢাকা শহরে জনসংখ্যা এবং যানবাহন কমে যাবে। এতে গ্রাম উন্নত হবে এবং ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ফলে বেকার মানুষেরা কাজের সন্ধানে আর ঢাকা আসবে না। একইসাথে ঢাকার বাইরে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধাকেও ডি-সেন্ট্রালাইজ করতে হবে। আশার কথা, সরকার ইতোমধ্যে সারাদেশে অনেকগুলো ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠা করছে, যেসব স্থানে শুধু শিল্প-কারখানা স্থাপন হবে। সরকার গ্রামকে শহরে পরিণত করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়িত হলে ঢাকার অবস্থান আরো উন্নত হবে।

যানজটের নগরী ঢাকা’র আরেক সমস্যার নাম জলজট বা পানিবদ্ধতা। একটুখানি বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তখন যানজট আরো বেড়ে যায় এবং নাগরিক জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সুতরাং ঢাকাকে যানজট মুক্ত করার পাশাপাশি পানিবদ্ধতা থেকেও মুক্ত করতে হবে। তার জন্য ঢাকা শহরে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ও পয়ঃনিস্কাশন সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে হবে। পলিথিন, প্লাস্টিক বোতল, ছেঁড়া কাপড় এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনায় ড্রেনগুলো ভরাট থাকে। ফলে বৃষ্টির পানি নামতে পারে না এবং এ কারণে পানি জমে যায়। নগরীর খালসমূহ চিহ্নিত করে এগুলোকে পুনঃখনন করতে হবে। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় পুকুর, লেক এবং জলাশয়কে ভরাট করার যে প্রতিযোগিতা চলছে তা এখনই বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পিত ড্রেনেজ এবং পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করেই ঘর বাড়ি এবং হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। হাউজিং কোম্পানিসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন করতে হবে এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বুড়িগঙ্গা দখল বন্ধ করতে হবে এবং শীতলক্ষ্যা খনন করতে হবে। ভরাট হয়ে যাবার কারণে শীতলক্ষ্যা আর আগের মতো পানি বহন করতে পারছে না। ঢাকায় যেসব খাল ছিল সেগুলোকে চিহ্নিত করে পুনঃখনন করতে হবে। সরকারি হিসাব মতেই, কাগজে-কলমে থাকলেও ঢাকা শহরের ২৩টি খালের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এগুলো ভরাট হয়ে গেছে বহু আগেই। সুতরাং এসব খাল খনন করতে হবে এবং নগরীর ড্রেনগুলোর সাথে এসব খালের সংযোগ ঘটাতে হবে, যাতে করে অতি সহজেই ড্রেন থেকে পানি খালে আসতে পারে। আর এই খালসমূহের সাথে নদীর সংযোগ ঘটাতে হবে। তাহলেই নগরীর পানি বিভিন্ন ড্রেন হয়ে খালে এবং খাল হয়ে নদীতে চলে যাবে। এজন্য রাজউককে স্পেশাল পরিকল্পনা নিতে হবে। এছাড়া ঢাকা শহরের আশে পাশের নিম্নাঞ্চলসমূহ ভরাট করে একশ্রেণির হাউজিং কোম্পানির অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা তৈরির কারণে ঢাকা শহরের পানি আর আগের মতো নামতে পারছে না। এসব সমস্যা সমাধান করে পরিকল্পিত ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনে একটি বিশেষ মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। এদের কাজ হবে নিয়মিতভাবে ড্রেনসমূহ পরিষ্কার করা, খালগুলোকে চিহ্নিত করে খনন করা এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখা। পাশাপাশি, যেখানে সেখানে ময়লা আর্বজনা ফেলার অভ্যাস জনগণকে পরিহার করতে হবে। কারণ সব কাজ সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

এই পৃথিবীই আমাদের বাসস্থান, এখানেই আমাদের বাস করতে হবে। এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার জায়গা মানবজাতির কাছে নাই। সুতরাং এই পৃথিবীকে আমাদের স্বার্থেই বসবাসের উপযোগী রাখতে হবে। তার জন্য পরিকল্পিত শহর গড়তে হবে। প্রবাদ আছে, স্রষ্টা গ্রাম সৃষ্টি করেছেন আর মানুষেরা শহর সৃষ্টি করেছে। সুতরাং মানুষ যে শহর সৃষ্টি করেছে, সেই শহরকে সুন্দর এবং বসবাসের উপযোগী করে মানুষদেরই গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য সুন্দর এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। ঢাকা শহর আমরাই তৈরি করেছি এবং একে বিপর্যয়ের হাত থেকে আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। তার জন্য দেশপ্রেমিক এবং নগর বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সুচিন্তিত এবং সুনির্দিষ্ট পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। আসুন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঢাকাকে আরো অধিকতর বাসযোগ্য হিসাবে গড়ে তুলি।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন