গত রোববার কাশ্মীরের উরিতে অবস্থিত সেনা ঘাঁটিতে হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লাগার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ভারত এ হামলার ঘটনার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছে, হামলার পরপরই কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া পাকিস্তানকে দায়ী করার ঘটনা থেকে বোঝা যায় ভারতের অভিযোগ কতটা উদ্দেশ্যমূলক। দুই দেশের অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই ভারতীয় মিডিয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তানের উপর হামলা চালানোর জন্য ভারত সরকারের উপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানকে ‘একঘরে’ করার জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি যুদ্ধের প্রস্তুতিও শুরু করেছে। সীমান্ত ঘাঁটিগুলোতে সৈন্য মোতায়েনসহ যুদ্ধ বিমান ও অস্ত্র বহনকারী বিমান পৌঁছানো হয়েছে। গত বুধবার ভারতের পররাষ্ট্র দফতর সাউথ ব্লকের ‘ওয়ার রুমে’ তিন বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে দুই ঘন্টার গোপন বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদিকে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখানো হয়। বালুর মডেলে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করে বোঝানো হয়, কীভাবে আচমকা হামলায় পাকিস্তানকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া যায়। পাকিস্তানও সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সামরিক মহড়া, বিমান বাহিনীর টহল, যুদ্ধ বিমান প্রস্তুত রাখা, পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে রাস্তার ধারে যুদ্ধবিমান অবতরণ, আজাদ কাশ্মীরে বিমানবন্দরগুলোতে ফ্লাইট বাতিল ইত্যাদির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিকগুলো বলেছে, তাদের যুদ্ধবিমান ও অস্ত্রবহনকারী বিমান সীমান্ত ঘাঁটিতে পৌঁছেছে। হামলার উপযুক্ত জবাব দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত পাকিস্তান। তবে পাকিস্তান প্রথম আক্রমণ করবে না। আবার ভারতীয় বাহিনীকেও কোনোক্রমেই সীমান্তরেখা অতিক্রম করতে দেয়া হবে না। ভারত ও পাকিস্তানের এই যুদ্ধ প্রস্তুতি দেখে পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, যে কোনো সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে এবং এ যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ লাভ করতে পারে।
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন অবসানের সময় এই নীতি ঘোষিত হয় যে, প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে কাশ্মীর ইচ্ছা করলে পাকিস্তান বা ভারতের সাথে যোগ দিতে অথবা স্বাধীনভাবে থাকতে পারে। তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সবাই ধারণা করে কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগ দেবে। তবে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং জনমতের তোয়াক্কা না করে ভারতের সাথে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পস্তুন উপজাতিরা জম্মু ও কাশ্মীর দখল করলে ২৬ অক্টোবর ভারতীয় সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। ভারতের সেনাবাহিনী পস্তুনদের হটিয়ে বেশিরভাগ এলাকা দখল করে। বর্তমানে কাশ্মীরের ৬০ ভাগ ভারত, ৩০ ভাগ পাকিস্তান ও ১০ ভাগ চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মূলত কাশ্মীরের অধিকারিত্ব নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ’৪৭ সাল ছাড়াও ’৬৫ সালে যুদ্ধ হয়েছে। সীমান্ত সংঘাত তো লেগেই আছে। স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরী জনগণের দাবী দমন করার জন্য ভারতের সেনাবাহিনী সেখানে নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। অসংখ্য মানুষ এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে। নারী-শিশু ধর্ষিত হয়েছে। এ নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করেছে। তারা জম্মু ও কাশ্মীরে কত লোককে হত্যা এবং নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে তার পরিসংখ্যানও প্রকাশ করেছে। এ ধারা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে আন্দোলনরত জম্মু ও কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের পাকিস্তান মদদ দিচ্ছে বলে ভারত বরাবর অভিযোগ করে আসছে। সর্বশেষ গত রোববার উরিতে হামলায় ভারতীয় সৈন্যদের নিহত হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করে ভারত ফুঁসে উঠে এবং পাকিস্তানে হামলার প্রস্তুতি শুরু করে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্তত দুই দেশের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও প্রস্তুতি দেখে তাই মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারত কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পাকিস্তানকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কূটনৈতিক তৎপরতা ও ভারতের আক্রমণ ঠেকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সউদী আরব ও চীন পাকিস্তানের পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে যদি যুদ্ধ লেগে যায়, তবে তা দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, সারা বিশ্বে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এতে উভয় পক্ষে বিভিন্ন দেশ সমর্থন দিলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হওয়ায় এবং এ অস্ত্র ব্যবহার করা হলে এর ভয়াবহতা কল্পনাতীত হতে পারে।
এই উপমহাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধপরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তাদের যুদ্ধ বা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠা উচিত হবে না। এতে শুধু দেশ দুটিই ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে না, প্রতিবেশী দেশগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। সর্বোপরি বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, দেশ দুটিকে শান্ত ও স্থির হতে হবে, যুদ্ধ পরিস্থিতি এড়াতে সংযমী হতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ না করে পরস্পরের প্রতি যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। এই অঞ্চলের জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য উভয় দেশকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাশ্মীর সমস্যার নিরসন একমাত্র তার জনগণই করতে পারে। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে যে গণভোটের কথা বলেছে, তা মেনে নিয়ে জনগণের মতামতের মূল্যায়ন করলে সব সংকটের অবসান ঘটবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন