গত ১৮ জুন ২০২১ শুক্রবার সন্ধ্যায় বান্দরবানের রোয়াংছড়ির নওমুসলিম মো. ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের সন্ত্রাসীদের দায়ী করা হয়েছে এবং তারা এটাও বলেছেন যে, ইসলাম গ্রহণ ও মসজিদ নির্মাণ করার কারণেই ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে হত্যা করা হয়েছে। জেএসএস অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, ঘটনার মোটিভ এবং সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে তারা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি। পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আর তিনি ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আসছিলেন।
অথচ, আগে ওমর ফারুক ত্রিপুরার বাবা হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে পরিবারসহ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। শুধু ওমর ফারুক ত্রিপুরার বাবাই নন, বরং সে এলাকার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির অনেকেই বাপ-দাদার আচরিত ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছেন এবং তাতে কারো আপত্তি বা বাধা ছিল না। যারা সেখানে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছেন তারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সে এলাকাতেই নিরাপদে বসবাস করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সশ্রস্ত্র গ্রুপগুলো সেখানকার মানুষদের পূর্বপুরুষদের আচরিত ধর্ম হিন্দু, বৌদ্ধ ও প্রকৃতিপূজা পরিত্যাগ করে খ্রিস্টান হওয়াকে ভালো চোখে না দেখলেও তারা তাতে কখনো বাধা দিয়েছে বলে জানা যায় না। সে কারণেই খ্রিস্টান মিশনারিরা সেখানে নির্বিঘ্নে ধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে, আর তাদের ধর্ম প্রচারের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির, যাদের কোনো কোনোটির শতভাগ মানুষ খ্রিস্টান হয়েছে, কোনো কোনো জনগোষ্ঠির অর্ধেক বা তার কম-বেশি সংখ্যক মানুষ খ্রিস্টান হয়েছে। ফলে প্রতিনিয়তই এই এলাকায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাবও। তাদের প্রভাব সেখানকার সমাজ ব্যবস্থায় কতটা গভীরে তা বাইরে থেকে অনুধাবন করা কঠিন। এমনকি, নওমুসলিম ওমর ফারুক ত্রিপুরা হত্যার ঘটনার পেছনে যদি কোনো দিন খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব বের হয়ে আসে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান মিশনারিরা শুধুমাত্র ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করছেন কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এ সন্দেহের পেছনে তাদের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপই দায়ী।
দিনে দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপ্রতিরোদ্ধ খ্রিস্টান মিশনারিরা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন যে, অনেক সময় তারা প্রশাসনকেও পাত্তা দিতে চান না। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিল গত ১৫ মার্চ ২০১৪ বান্দরবান জেলায়। পার্বত্যনিউজসহ দুই-একটি অনলাইন মিডিয়ায় খবরটি যেভাবে এসেছিল তার সারমর্ম হলো: ‘বান্দরবান ফাতিমা রানী চার্চ-এ মহিলা হোস্টেলের মেয়েদের মিশনের ফাদার ও ব্রাদার কর্তৃক যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে। এরা সবাই বান্দরবান ডনবস্কো উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম থেকে ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। গত ১৫ মার্চ ৭১ জন ছাত্রী নদীতে গোসল করার নামে হোস্টেল থেকে বের হয়ে পালিয়ে গেলে ঘটনাটি জানতে পারে স্থানীয়রা। দুর্গম পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী দরিদ্র পিতা-মাতা বুক ভরা আশা নিয়ে তাদের সন্তানদের জেলা সদরে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করায়। এ সন্তানরা একদিন শিক্ষিত হয়ে মা-বাবা ও সমাজের মুখ উজ্জ্বল করবে। এমন প্রত্যাশায় পাহাড়ের দূরপল্লীর মেয়েরা ডনবস্কো উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ফাতিমা রানী চার্চ-এর হোস্টেলকেই নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। গত ১৫ মার্চ ৭১ জন ছাত্রী হোস্টেল থেকে পালিয়ে যায়। হোস্টেল থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাত্রীদের কেউ কেউ আশ্রয় নেয় তাদের নিকট আত্মীয় ও বান্ধবীদের বাড়িতে। কর্তৃপক্ষ কিছু ছাত্রীকে হোস্টেলে ফিরিয়ে আনলেও তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ দেয়নি মিডিয়াকর্মী এবং প্রশাসনকে।’
এত বড় একটি ঘটনা! অথচ, বাংলাদেশের মূল ধারার কোনো গণমাধ্যমে তা খবর হয়ে এলো না কেন? অথচ, দেশের কোনো মহিলা মাদরাসার হোস্টেল, এতিমখানা কিংবা কোনো কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে যদি একই ধরনের অভিযোগে ৫ জন ছাত্রীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটত, তাহলে আমাদের মিডিয়া সে ঘটনাকে কতটা রসিয়ে রসিয়ে ফলাও করে প্রচার করত! অনেকে হয়তো ফলোআপ নিউজ করে করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই বারোটা বাজিয়ে দিত। আর এর জন্য তাদের তথ্য প্রমাণেরও খুব একটা প্রয়োজন হতো কি? অথচ কী অদ্ভূত ঘটনা, মিশনারিদের একটি হোস্টেল থেকে ৭১ জন ছাত্রীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার সংবাদও চেপে গেল বাংলাদেশের মিডিয়া! শুধু মিডিয়া নয়, প্রশাসনও চেপে গেছে বিষয়টি। শুনেছি, প্রথম দিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তারা হোস্টেল কর্তৃপক্ষের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারেননি। কারণ, চার্চ কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে কোনো সহায়তা করারই প্রয়োজন মনে করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে এক সময় কেউ খ্রিস্টান ছিল না। বান্দরবানসহ তিন জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির অধিবাসীরা ছিলেন মূলত বৌদ্ধ, হিন্দু এবং প্রকৃতিপূজারি। আর তাদের পাশাপাশি মিলেমিশে ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। ব্রিটিশরা উপমহাদেশে আসার সময় তাদের সাথে সাথে খ্রিস্টান মিশনারিরাও এসেছেন। মিশনারিরা শুরুতে সমতল-অসমতল সকল অঞ্চলের মানুষের মধ্যেই খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারেন যে, সমতলে বসবাসকারী অপেক্ষাকৃত অগ্রসর জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত করার চেয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত করাটা অনেক সহজ এবং নিরাপদ। তাই তারা বাংলাদেশের যেখানেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির দেখা পেয়েছেন, সেখানেই আস্তানা গেড়েছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলোকে ধর্মান্তরিত করার টার্গেট করেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও এবং দাতা সংস্থার সহায়তায় তারা পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলোকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রলুব্ধ করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তর করা শুরু করেন। মিশনারিদের প্রচেষ্টায় আজকের বাস্তবতা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের শুধু বান্দরবান নয়, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এমনকি কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকাগুলোতে বসবাসরত কোনো কোনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শতভাগ এবং কোনো কোনো জনগোষ্ঠির আংশিক জনসংখ্যা ইতোমধ্যে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে।
মিশনারিদের প্রভাবের গভীরতা ঠিক কতটা, তা বোঝা যাবে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টের সূত্র ধরে ২০১১ সালের ১০ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাবে ‘খ্রিস্টান বানানো হচ্ছে উপজাতীয়দের’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, “দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪৫টি উপজাতির অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে ১৪টি উপজাতি। এসব উপজাতির ৩০.৫৭ ভাগ চাকমা, ১৬.৬০ ভাগ মারমা, ৭.৩৯ ভাগ ত্রিপুরা, ৬.১৬ ভাগ অন্যান্য উপজাতি। অবশিষ্টরা বাঙালি। পার্বত্যাঞ্চলের প্রধান এ তিনটি উপজাতির মধ্যে প্রথাগতভাবে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। গত দুই দশকে এসব জেলায় খ্রিস্টান ধর্মের বিস্তার ঘটেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। গত জুন (২০১১) মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় কোরআন শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র স¤প্রসারণের সম্ভাব্যতা যাচাই, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, বান্দরবান জেলায় এখন মুসলমান ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬২ জন। খ্রিস্টান ১ লাখ ৩ হাজার ৯৯৭ জন। বৌদ্ধ ৩০ হাজার ৫৪৬ জন। হিন্দু ১০ হাজার ৭৯৬ জন। দু’দশক আগে এ জেলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যার দিকে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও এখন তারা তৃতীয় স্থানে চলে এসেছে। খ্রিস্টান ধর্মানুসারীদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দ্বিতীয়।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বান্দরবান রুমা উপজেলার গেলাইঙ্গা, রেমাকৃপাংশা, ফাইন্দু ইউনিয়নে খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও কিছু হিন্দু পরিবার বাস করত। অথচ, মারমা ও বোম উপজাতি অধ্যুষিত রুমা উপজেলার এখন ৬০ ভাগ জনসংখ্যাই খ্রিস্টান। অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। রুমা বাজার থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে আশ্রম পাড়ায় একবার ৪-৫টি ত্রিপুরা পরিবার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। আর্থিক অনটনে পড়ে তারা মুসলমানদের সাহায্যপ্রার্থী হলে আশানুরূপ সাড়া পায়নি। এ সুযোগে জাইনপাড়াস্থ খ্রিস্টান মিশনারি চার্চ তাদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে। রুমা উপজেলার এসব নওমুসলিমদের খ্রিস্টান মিশনারিরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েই বশে এনেছে, তাদেরকে খ্রিস্টান বানিয়েছে। কারণ, কোনো উপজাতি ইসলামের সাম্য ভাতৃত্বের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে, এমন খবর যদি মিশনারিরা পায় তাহলে তারা তৎপর হয়ে উঠে। ছলে-বলে কিংবা কলে-কৌশলে যেভাবেই হোক তাদেরকে খ্রিস্টান বানাতে সচেষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে পাহাড়ি বিভিন্ন সংগঠন এমনকি রাষ্ট্রীয় বাহিনীকেও তারা কাজে লাগাতে পিছপা হয় না। ২০১৩ সালে রাঙ্গামাটি জেলায় নওমুসলিমের ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই ঘটেছে।
ঘটনাটি এরূপ- ‘গত ২ জানুয়ারি ২০১৩ ঢাকার বাসাবোর একটি মাদরাসায় হানা দিয়ে পুলিশ ৫ জন উপজাতীয় নওমুসলিম অভিভাবক এবং তাদের ১৬ সন্তানকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে তাদের ইসলাম গ্রহণের এফিডেভিট ও অন্যান্য বৈধ কাগজপত্র দেখে পুলিশ ১১ শিক্ষার্থী ও তাদের ৫ অভিভাবককে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৫ জন ছাত্র আগে থেকেই মাদরাসায় পড়তো বলে তাদের অভিভাবক সাথে ছিল না। অভিভাবক আসা পর্যন্ত তাদের তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখে পুলিশ। পরে অভিভাবকরা তাদের আনতে গেলে ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের সদস্য পরিচয়ে কতিপয় উপজাতীয় লোক তেজগাঁও থানার সামনে থেকে মাদরাসায় যেতে না দিয়ে তাদের জোর করে ধরে নিয়ে যায়। উপজাতীয় এসব লোক অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের মাদরাসায় যেতে না দিয়ে খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চ নিয়ন্ত্রিত একটি এনজিও সংস্থার কাছে দিয়ে দেয়। জানা গেছে, উক্ত ক্যাথলিক চার্চ নিয়ন্ত্রণ করেন রোজালিন ডি কস্তা।’ এছাড়া একই সময়ে গাজীপুরের মিয়াপাড়ায় দারুল হুদা মাদরাসা থেকেও উপজাতীয় নওমুসলিম ছাত্রদের ধরে নিয়ে মিশনারিদের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব উপজাতীয় নওমুসলিম রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার দুমদুমিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তারা ছিলেন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোক।
পার্বত্য জনগণের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদের ধর্মান্তরিত করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে মিশনারি প্রভাবিত এনজিওগুলো। স্বাস্থ্যসেবা ও মানবসেবার নাম করে এসব এনজিও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সেবার আড়ালে তাদের একটাই লক্ষ্য, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা। তিন পার্বত্য জেলা তথা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জেলায় এক সময় বৌদ্ধ, মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বেশি থাকলেও বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, যা উপরের পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয়। এর পেছনে যেসব এনজিও ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ আছে তার মধ্যে রয়েছে- অ্যাডভানটেজ ক্রুশ অব বাংলাদেশ, হিউম্যানিট্রেইন ফাউন্ডেশন, খ্রিস্টান কমিশন ফর ডেভলপমেন্ট বাংলাদেশ (সিসিডিবি), ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান ক্রুশ, ডানিডা, ওয়ার্ল্ড ভিশন, কৈনানিয়া, শান্তিরানী ক্যাথলিক চার্চ, গ্রিন হিল, গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা (গ্রাউস), মহামনি শিশু সদন, জাইনপাড়া আশ্রম, তৈদান, আশার আলো, তৈমু প্রভৃতি। এনজিওগুলোর নানা প্রলোভনে পড়ে দলে দলে ধর্মান্তরিত হচ্ছে পাহাড়ি উপজাতীয় জনগোষ্ঠি। এছাড়াও ইউএনডিপি ও ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন রেজিস্টার্ড ও নন রেজিস্টার্ড এনজিওর মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের আড়ালে মূলত খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে। একই সাথে এসব এনজিও প্রতিনিয়ত উপজাতীয়দের বাঙালিবিদ্বেষী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সদস্যরা যে হারে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে তা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে বৌদ্ধ জনসংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে এলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অথচ, বৌদ্ধ ধর্মের ধারক-বাহকরা তাদের ধর্মের ওপর এই হুমকির বিষয়ে একেবারেই উদাসীন অথবা সব কিছু জেনে-শুনেও অজ্ঞাত কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা এবং পাহাড়ি বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও তাদের ধর্মের ওপর খ্রিস্টান ধর্মের থাবার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছেন না। বরং তারা মিশনারিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উল্টো মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বেড়াচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলোকে জোর করে মুসলমান বানানো হচ্ছে বলে বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এনজিও এবং দাতাসংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক বিদেশি নাগরিককে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু তারপরও এদের দৌরাত্ম্য থামেনি, বরং দিন দিন বাড়ছে। অনেক সময় পর্যটকের ছদ্মবেশেও বিদেশি নাগরিকরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বাঙালি মুসলমান ও বাংলাদেশ বিদ্বেষী মনোভাব উস্কে দিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কাজে নেমে পড়েন। এমন অভিযোগের ভিত্তিতেও পাহাড় থেকে বিদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন সময় বহিষ্কৃত হতে হয়েছে।
ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা এবং এর সংলগ্ন মায়ানমারের কিছু পার্বত্য এলাকা ও ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ খ্যাত রাজ্যগুলোর সমন্বয়ে খ্রিস্টান অধ্যুষিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল। পশ্চিমাদের এই কল্পিত রাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে শুরু করে চীনের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কারণেই এই অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলোকে স্থানীয় সমতলবাসীদের থেকে সুপরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে মিশনারিদের দ্বারা খ্রিস্টান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকেই। ১৯০০ সালে ব্রিটিশরা যে হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে পাহাড়ি জনগণকে স্থানীয় বাঙালি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নকরণ করে তার মূলেও ছিল তাদের সেই পরিকল্পিত রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা। এটা করা হয়েছিল মূলত স্থানীয় বাঙালিদের থেকে পাহাড়িদের বিচ্ছিন্ন রেখে তাদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা সহজ হবে এই আকাক্সক্ষায়। ব্রিটিশরা তাদের এই কল্পিত রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময়েও এই অঞ্চলটিকে ভারত কিংবা পাকিস্তান কারও অধীনেই না রাখার পক্ষপাতি ছিল। তাদের ধারণা ছিল যে, এই অঞ্চলটি ভারত কিংবা পাকিস্তানের অংশ না হলে এখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠিগুলোর হয়তো পক্ষে সফল এবং কার্যকর রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠন সম্ভব হবে না। এই সুযোগে ব্রিটিশরাই আবার ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয়ে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে তরান্বিত করতে পারবে।
সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা যে এখনো তৎপর তা তাদের কর্মকান্ড দেখলেই বোঝা যায়। কারণ, একদিকে তারা যেমন স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলোকে খ্রিস্টান বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে, তেমনি তারা স্থানীয় জনগণকে বাঙালি মুসলমান, বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনী বিদ্বেষী করে তুলছে। একই সাথে ‘আদিবাসী’ কনসেপ্ট, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিগুলোকে স্থানীয় সর্বাধিক প্রচলিত ভাষার পরিবর্তে মাতৃভাষায় শিক্ষিত করার কনসেপ্ট দিয়ে রাষ্ট্র এবং স্থানীয় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার মিশন বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে যেসব জনগোষ্ঠির বর্ণমালা নেই তাদের ভাষাকে রোমান হরফে লেখার প্রচলন করা হচ্ছে, যাতে এসব জনগোষ্ঠির যোগাযোগটা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র এবং তার জনগণের সাথে না হয়ে পশ্চিমাদের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়, বিশেষ করে যারা রোমান হরফ ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে হয়। পশ্চিমাদের আশীর্বাদপুষ্ট মিশনারিদের এই অপতৎপরতা যে শুধু বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় সীমিত তা কিন্তু নয়, একই মিশন নিয়ে তারা কাজ করছে মায়ানমার এবং ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোতেও।
একই সাথে তারা এসব অঞ্চলের জনগণের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টাও করছে। ভিন্ন দেশের সীমানায় বসবাস করা একই জনগোষ্ঠির লোকজনদের বিশেষ বিশেষ সংগঠনের আওতায় সংগঠিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত চাকমা এবং ত্রিপুরাদেরকে সমন্বিত করে ইতোমধ্যে একাধিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অপরদিকে এসব অঞ্চলে যেসব মিশনারি তৎপরতা চালাচ্ছে তারাও দুর্গম ও অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করে তাদের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করছে। কয়েক বছর আগে মায়ানমার থেকে এভাবে কয়েকজন মিশনারি বান্দরবানে প্রবেশের ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় বেশ তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু দুর্গম অঞ্চলের সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় সব খবর তো প্রশাসনের পক্ষে রাখাও সম্ভব না, তাই এমন ঘটনা হরহামেশায় ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তার সংলগ্ন মায়ানমার ও ভারতের রাজ্যগুলোর এ চিত্রকে পূর্বতিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের ইতিহাস এবং ঘটনা চিত্রের সাথে মিলিয়ে দেখলে, আশা করি সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান মিশনারি তৎপরতা এবং খ্রিস্টানাইজেশন শুধু বাঙালি মুসলমান এবং বাংলাদেশের সমস্যা এটা ভাবলে বোকামি হবে। কেননা, এ সমস্যা থেকে রেহাই পাবে না ভারত, মায়ানমার; এমনকি চীনের জন্যও এটা আতঙ্কজনক একটি বার্তা। কারণ, এই এলাকা খ্রিস্টান প্রধান অঞ্চলে পরিণত হলে এদের যোগাযোগ ভারত কিংবা চীনের পরিবর্তে পশ্চিমাদের সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠ হবে। আর সেটা হলে বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান সুপার পাওয়ার চীন এবং ভারতের জন্য তা অস্বস্তির কারণ হতে বাধ্য।
সার্বিক বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, বান্দরবানে নওমুসলিম ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে জেএসএস (সন্তু) বা অন্য কোনো গ্রুপের সন্ত্রাসীরা হত্যা করে থাকলেও তার পেছনে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কেননা, ইতোপূর্বে তারা বহু নওমুসলিমকে নানা কৌশলে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। তাই, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে ওমর ফারুক ত্রিপুরা হত্যার সঠিক কারণ এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদান জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে গুটিকয়েক নওমুসলিম পরিবার রয়েছে তারাসহ স্থানীয় সকল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এবং ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা বিধানে যা যা প্রয়োজন সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে পার্বত্যাঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রম চালানোর নামে খ্রিস্টানাইজেশন এবং ভবিষ্যতের বাফার স্ট্যাট তৈরির নীল নকশার সাথে জড়িতদের ব্যাপারে সরকারের সঠিক এবং দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করাও প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
sayedibnrahmat@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন