শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহানগর

দুঃখ গড়া জীবন যার পটিয়ার আরেক ‘আসমানী’মেহেরাজ খাতুন!

প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এস কে এম নুর হোসেন, পটিয়া থেকে : পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের আলোচিত কবিতা গুচ্ছের মধ্যে ‘আসমানী’ কবিতা অন্যতম। কবিতার কয়েক লাইনের মধ্যে যেমন, ‘আসমানীকে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহি মুদ্দির ছোট্ট বাড়ী রসুল পুরে যাও। বাড়িতো নয় পাখির বাসা ভেন্নাপাতার ছানি, একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি \ সত্তর দশকে রচিত এ কবিতা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। দরিদ্র পিঁড়িত সংসারে আসমানী বিয়ের পরে রসুলপুরের স্বামী রহিম উদ্দিনের ঘরে আসমানীর কষ্টময় জীবনের কথা তুলে ধরে ছিলেন পল্লী কবি জসীম উদ্দীন। সেই আসমানী সারা জীবন দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করার পর বিগত পাঁচ বছর পূর্বে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। কবি জসীম উদ্দীনের নাম ভূমিকায় রচিত কবিতার আসমানীর মত জীবন নিয়ে বেঁছে আছে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার খরনা গ্রামের গাঙ্গেরকুল এলাকার মেহেরাজ খাতুন। তার বয়স বর্তমানে ৯০ বছর। লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এ মেহেরাজ খাতুনের দীর্ঘ জীবন পার হয়ে এসেছে। দুঃখে জীবন গড়া এ মেহেরাজ খাতুনের জন্ম ১৯৩৬ সালে চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী চাগাচর গ্রামে।
বিশ বছর বয়সে মেহেরাজ খাতুনের বিয়ে হয় পটিয়া উপজেলার খরনা গাঙ্গেরকুল এলাকার নুর আহমদের দি¦তীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে হয় মেহেরাজ খাতুনের। সতীনের সংসারে যন্ত্রণাদায়ক জীবন অতিবাহিত করার ১৩ বছর পরেই ১৯৬৯ সালে স্বামী নুর আহমদ মারা যায়। মেহেরাজ খাতুনের ছোট দুই ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে আরেক কষ্টের জীবন শুরু হয়। তার দুই ছেলে ভালোভাবে আয় রোজগার না করার কারণে মেহেরাজ খাতুনকে অধিকাংশ সময় মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হত। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তার ছেলেমেয়েরা পাশে থাকলেও বড় ছেলে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। এ সময় তার মেয়েটিকে পার্শ্ববতী গ্রাম লালারখীলে বিয়ে দেয়। এরপর তার একটি ছেলে নিয়ে কয়েক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ছেলেটি ২/৩টি বিয়ে করে মেহেরাজ খাতুন থেকে দূরে সরে যায়। ছেলেমেয়ে সবাইকে হারিয়ে মেহেরাজ খাতুনকে অবশেষে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিতে হয়। বিগত ২৫ বছর যাবত ভিক্ষা করে চলছেই তার জীবন। এলাকায় হতদরিদ্রের প্রশ্ন আসলে তার নাম উঠে আসে আগে। কিন্তু মেহেরাজ খাতুন সরকারী অনেক সাহায্য থেকে বঞ্চিত। একটুখানি বৃষ্টি হলে আসমানীর ঘরের মত মেহেরাজ খাতুনের ঘরেও পানি গড়িয়ে পড়ে। অথচ ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে, ৯৬-এর প্রবল বন্যায় সরকার ঘূর্ণি দুর্গত, বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য টিন সরবরাহ দিলেও মেহেরাজ খাতুন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একপিস টিনও পায়নি। গত ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বয়স্কভাতা ও বিধবাভাতা চালু করলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তার জন্য বয়স্কভাতার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর থেকে কোন ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার তার জন্য ভিজিএফ কার্ডের চাল ও রিলিফের ভিজিটি চাল তাকে দেয়নি। ইউনিয়ন পরিষদের চাল দেয়ার খবর পেলে মেহেরাজ খাতুন পরিষদে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে কোন প্রকার চাল দেয়া হয় না। দীর্ঘক্ষণ পর তাকে জানিয়ে দেয় তুমি বয়স্কভাতা পাচ্ছ তোমাকে চাল দেয়া হবে না। এভাবে সরকারী বরাদ্দের অনেক সাহায্য থেকে বঞ্চিত এ মেহেরাজ খাতুন।
বর্তমানে তার বিয়ে দেয়া মেয়েটি সতিনের ঘরের ছেলেদের অত্যাচারে থাকতে না পেরে মায়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তার খাবারও মেহেরাজ খাতুনকে যোগাতে হচ্ছে। ৯০ বছর বয়সী অশীতিপর বৃদ্ধা মহিলা মেহেরাজ খাতুন যে সময় বাড়িতে বিশ্রাম নেয়ার কথা সে সময় লাঠির উপর ভর করে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যায় দু’মুঠো ভিক্ষার আশায়। মেহেরাজ খাতুন দুঃখ করে জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর খরনা ইউনিয়ন পরিষদে ঈদুল আযহা উপলক্ষে চাল বিতরণ করছিল। এ সময় আমি খবর পেয়ে পরিষদে গেলে আমাকে চাল দেয়ার কথা বলে প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পর চেয়ারম্যান ও মেম্বার রিলিফের চাল না দিয়ে চাল শেষ হয়ে গেছে জবাব দেয়। এতে আমি সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় থাকার পর বাড়ি ফিরে যাই। অথচ অনেক বয়স্ক ও বিধবা ভাতা পায় এমন ব্যক্তিদের রিলিফের চাল দিয়ে থাকলেও আমি বঞ্চিত। জনম দুঃখী মেহেরাজ খাতুন তার বয়সের ভারে বর্তমানে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। তবুও দু’মুঠো অন্ন যোগাতে রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করে মেহেরাজ খাতুন বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে। এভাবে ঘুরতে গিয়ে যে কোন সময় তার জীবনের চাকা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে তার পাশে দাঁড়াবার কেউ কি নেই?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন