রাজধানীর মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের রহস্য উদ্ঘাটন করা যাচ্ছে না। এ ঘটনায় গতকাল রাত পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ও অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৫২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। বিস্ফোরণে কেবল সেই ভবনটিই নয়, আশপাশের আরো ১২টি ভবনেরই কাচের দেয়াল বা জানালা সবই ভেঙে পড়ে। ঠিক ওই সময়ই ৩টি বাস অতিক্রম করছিল ওই এলাকা দিয়ে। সেই বাসেরও জানালার সব গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তবে গতকাল বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস ও সিআইডির কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেছেন, ৭৯ আউটার সার্কুলার রোড ঠিকানার ভবনটির নিচতলায় গ্যাস সিলিন্ডার, গ্যাসলাইন, এসি অথবা বিদ্যুৎ থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এত ভয়াবহ বিস্ফোরণ হওয়ার কথা নয় বলে কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন। মূলত যেখান থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই শরমা হাউসের নিচতলায় হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ১৬ ঘণ্টা পর মগবাজার আউটার সার্কুলার রোডটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। গতকাল দুপুর ১টার দিকে যান চলাচল শুরু হয়। গত রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তবে গতকাল বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রাথমিকভাবে নাশকতার আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, সেখানে মিথেন গ্যাসের আলামত পাওয়া গেছে। আইজিপি আরো বলেন, ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনাটি তদন্তে পুলিশের বোম ডিসপোজাল ও স্পেশাল ইউনিটের সমন্বয়ে কমিটি করা হবে। তারা বিষয়টি গভীর থেকে খতিয়ে দেখবে। এখন পর্যন্ত এই বিস্ফোরণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। ভবনের ভেতরে বড় ধরনের একটা শক ওয়েভ তৈরি হয়েছিল। এখনও মনে হচ্ছে কোনো নাশকতা নয়। একমুখী ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। বোমা হলে চতুর্মাত্রিক ধ্বংসযজ্ঞ হতো। তবে সবগুলো বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করে দেখা হবে।
এছাড়া সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান বলেছেন, গ্যাস সিলিন্ডার, গ্যাসলাইন, এসি অথবা বিদ্যুৎ থেকে এ দুর্ঘটনা হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। অন্য কিছুর আলামত পাওয়া যায়নি। তবে যেসব আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে তা ফরেনসিক করলে আরো বিস্তারিত জানা যাবে।
মগবাজারে শরমা হাউসের নিচতলায় হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, হাইড্রোকার্বন হলো প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি উপাদান। তবে শুধু গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অস্বাভাবিক। শরমা হাউসে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শনের পর তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে। এখন পর্যন্ত কীভাবে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। শুধু গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অস্বাভাবিক। তদন্ত সাপেক্ষে আসল কারণ জানা যাবে। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলেছেন, সঠিক নজরদারি ও যথাযথ ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে মগবাজারে সংঘটিত বিস্ফোরণের মতো আরো অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলে পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, আমাদের সেফটি সিকিউরিটি সিস্টেম উদ্বেগজনক। এই ঘটনা সবার জন্য অ্যালার্মিং। আমরা ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি ও বিস্ফোরণের বিষয়গুলো অবজার্ভ করেছি। ঘটনাস্থলে আমরা এখনো ৮/৯ শতাংশ মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছি। এখানে যদি বোম জাতীয় কিছু থাকত, তাহলে আরও বেশি এক্সপ্লোশন হতে পারতো।
ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় বৈদ্যুতিক লাইনে কোনো সমস্যা পায়নি। সেই সঙ্গে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে এই ঘটনা ঘটেনি। প্রাথমিক তদন্তে ভবনটির আশেপাশের সব বৈদ্যুতিক তার এবং ট্রান্সফরমার সবই অক্ষত দেখা গেছে। তবে ভেতরে কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক ত্রুটি হয়েছিল কি না তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত আরো ১৩ ভবন : মগবাজার আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর বিস্ফোরিত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। একই সঙ্গে আশপাশের আরো ১৩টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, বিস্ফোরণে ১২টি বাণিজ্যিক ভবন ও ২টি আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ৩টি যাত্রীবাহী বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো হলোÑ আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর ভবন, নজরুল শিক্ষালয়, রাশমনো স্পেশালাইজড হাসপাতাল, বিশাল সেন্টার, আড়ং শোরুমের ভবন, বেস্ট বাই শোরুমের ভবন, ডম-ইনো’র বাণিজ্যিক ভবন, ক্যালকাটা ড্রাই ক্লিনার্সের ভবন, বেঙ্গল ট্রেডস সেন্টার ভবন, হামদর্দ চিকিৎসা ও বিক্রয় কেন্দ্র, ভিশন অ্যাম্পোরিয়ামের শোরুম এবং মগবাজার প্লাজা ভবন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর প্রতিটিই বহুতল। ভবনগুলোতে একাধিক দোকানসহ বাণিজ্যিক কার্যালয় রয়েছে। বিস্ফোরণের কারণে অফিস ও দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন বলেন, রোববার সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটে আমরা সংবাদ পাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টিম ঘটনাস্থলে আসে। এটি একটি বহুতল ভবন। এর নিচতলায় ফাস্টফুডের দোকান, দ্বিতীয় তলায় সিঙ্গারের একটি গোডাউন ছিল। বিস্ফোরণের কারণে ব্লাস্ট ওয়েভ ও সাউন্ড ওয়েভ সৃষ্টি হয়। এ কারণে আশপাশের ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ভবনের সব পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি এখনই বলতে পারি এই ভবন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, গ্যাস বা এ জাতীয় কোনো কিছুর মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা করছি। গ্যাস জাতীয় কিছু থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ভবনের ভেতরে জমে থাকা গ্যাসে একটি চেম্বারে পরিণত হয়ে থাকতে পারে। সেই চেম্বারে স্পার্ক জাতীয় কিছু হয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমাদের তদন্ত দল আলামত সংগ্রহ করছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সংগৃহীত আলামত বিশ্লেষণ শেষে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তিনি বলেন, ভবনটির দেয়াল এবং ওপরের ছাদ ভয়াবহ আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিলারগুলোরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই এই ভবনে বসবাস অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনটি যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে।
ছোট্ট নূহার প্রশ্ন বাবা কখন আসবে : মগবাজারে বিস্ফোরণের পর বন্ধু, সহকর্মী এবং বড় দুলাভাই সারা রাত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও থানায় রুহুল আমিন নোমানকে (৩২) খুঁজে বেড়িয়েছেন। কিন্তু কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। রাতে রমনা থানায় যান বড় বোনের স্বামী মাহফুজুর রহমান। থানা থেকে সোমবার সকাল ৯টার দিকে ফোন করে জানানো হয়, মগবাজার বিস্ফোরণে যে ৬ জন মারা গেছেন, তাদের একজনের নাম রুহুল আমিন। পরে লাশ শনাক্ত করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে যান মাহফুজুর। লাশ শনাক্ত করেন। কিন্তু দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিবারের কাউকেই জানাননি যে রুহুল আমিন আর নেই। ঢাকা মেডিক্যালের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পরে রুহুল আমিনের বন্ধু এবং অন্যান্য সহকর্মীদের পরামর্শে পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি জানান তিনি। আকস্মিক এমন সংবাদে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য রুহুলের তিন বছরের মেয়ে নূহাকে বোঝানো যায়নি তার বাবা আর আসবেন না। অন্য সদস্যদের বারবার জিজ্ঞাসা করছে বাবা কখন আসবে।
বিস্ফোরণে হতাহতদের বেশিরভাগই বাসযাত্রী-পথচারী : বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত অধিকাংশই বাসযাত্রী ও পথচারী ছিলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে টিকিৎসাধীন আহতদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়। আহতদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ঘটনাস্থলের আশপাশের বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী ও ক্রেতা। আহত কয়েকজন বাসযাত্রী জানান, ঘটনার সময় তারা ওয়ারলেস এলাকায় যানজটে বাসে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজে বিস্ফোরণে বাসের চতুর্দিক থেকে কাচগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কাচ বিদ্ধ হয়ে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে।
পথচারী জামাল জানান, তিনি মতিঝিলের একটি হোটেলে চাকরি করেন। কর্মস্থল থেকে মগবাজারে বাসায় হেঁটে ফেরার সময় ওয়ারলেস মোড়ে পৌঁছালে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। কাচের টুকরা এসে তার শরীরে বিদ্ধ হয়। ওয়ারলেস এলাকার মাংসের দোকানের কর্মচারী ইমরান হোসেন সুমন ঘটনার সময় দোকানের ভেতরে অবস্থান করছিলেন। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় শেখ হাসিনা বার্নের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি।
পুলিশের তদন্ত কমিটি : বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিএমপির সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে। এই কমিটিতে এসবি ও সিআইডিসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানসহ আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে পুলিশ সদরদফতর থেকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন