শতবর্ষের যাত্রা পূর্ণ করলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই পথচলা শুরু করা দেশের উচ্চশিক্ষার এই অনন্য প্রতিষ্ঠানটির বয়স এখন পুরো এক শতাব্দী। বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে জ্ঞান উৎপাদন ও জ্ঞান বিতরণের মহান দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে অভিনব উদ্ভাবনে সমৃদ্ধ করেছে এই বসুন্ধরাকে, প্রসিদ্ধ হয়েছে জগদ্ব্যাপি, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই নাম কুড়িয়েছে গণতন্ত্র ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে, দেশের রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। সর্বাত্মক লকডাউনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পূর্বনির্ধারিত ১ জুলাইয়ের অনুষ্ঠান আজ বুধবার ৩০ জুন সীমিত পরিসরে উদ্বোধন করা হয়। এ উপলক্ষে সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনস্থ অ্যালামনাই ফ্লোর চত্বরে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করা হয়।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আজাদ এসময় বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে, সেজন্য শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংকের বৃত্তি দেয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। তিনি বলেন, আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন করতে পারছি। আগামী এক বছর এই শতবর্ষের অনুষ্ঠান পালন করা হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা সকলের সদয় সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। মহান এ বিদ্যাপীঠের স্বনামধন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ (মুজিব বর্ষ), মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ-জয়ন্তী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের বিরল সৌভাগ্য প্রাপ্তির ক্ষণে আমরা দেশের শিক্ষা ও গবেষণার মানকে আরও উন্নত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। বিশ্ববিধ্বংসী কোভিড-১৯ ভাইরাসের তীব্রতর সংক্রমণের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা এগিয়ে যাব এবং কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করব, ইনশাল্লাহ।
একটু যদি পেছনে যাই, ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শের-এ-বাংলা হিসেবে পরিচিত রাজনীতবিদ এ কে ফজলুল হক এবং অন্যান্য কয়েকজন নেতা। এর আগে পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য যেতে হতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল পুরো দেশে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অংশ হিসেবে। ১৮৫৭ সালে ভারতের বড় লাট লর্ড ক্যানিং 'দ্য অ্যাক্ট অফ ইনকরপোরেশন' পাশ করে ওই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা ছাড়া বাকি দুটো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বোম্বে ও মাদ্রাজে। (বিবিসি বাংলা) এর আগে থেকেই অবশ্য ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ইউরোপীয় মডেলে। তৎকালীন প্রশাসনিক অঞ্চল বাংলা ভাগ করা হয়েছিল ১৯০৫ সালে। তার আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি ডিগ্রি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় ছিল নয়টি। তবে সেই সংখ্যা পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করেননি তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ। বাংলা প্রেসিডেন্সি ১৯০৫ সালে ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়। বাংলা ভাগ করার ওই ঘটনা প্রচলিত হয় বঙ্গভঙ্গ নামে। পূর্ববঙ্গে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অগ্রসর পথে এগিয়ে নিয়ে আসা ছিল এই উদ্যোগের একটি অংশ। কিন্তু বাংলার বিভক্তি টিকে ছিল খুবই কম সময়ের জন্য - মাত্র ছয় বছর। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু নেতাদের প্রবল আন্দোলনের মুখে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করা হয়। ইতিহাসবিদরা বলছেন, বঙ্গভঙ্গ রদ করার ক্ষতিপূরণ হিসাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে তখনকার ব্রিটিশ সরকার।
১৯১২ সালের ২৭ মে গঠিত হয় ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট 'ঢাকা ইউনিভার্সিটি কমিটি', যেটি পরিচিতি পায় নাথান কমিশন নামে। তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায় কি-না, সেটি যাচাই-বাছাই করে দেখা এবং এ সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা দেয়া। এ কমিটির সদস্য ছিলেন বাংলার গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক জি. ডব্লিউ. কুচলার, কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট ড. রাসবিহারী ঘোষ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, জমিদার ও উকিল আনন্দ চন্দ্র রায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ. এ. টি আর্চবোল্ড, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা মাদ্রাসার (পরবর্তীকালে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) সুপারিন্টেনডেন্ট শামসুল উলামা আবু নসর মুহাম্মদ ওয়াহেদ, আলীগড়ের মোহাম্মদ আলী, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ. আর. জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি. ডব্লিউ. পিক এবং কলকাতা সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল সতীশচন্দ্র (চ্যান্সেলর)। সেই কমিশন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিবেদন দেয়ার পর ডিসেম্বর মাসেই সেটি অনুমোদন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার সাতটি কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত থাকবে। আর এটি হবে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার, লিডস, লিভারপুল প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অবকাঠামোগত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৩ লাখ টাকা, আর বাৎসরিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ লাখ টাকা। বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার আওতায় পূর্ববাংলা ও আসাম সরকারের রমনা এলাকায় এর আগে অধিগ্রহণ করা ভূমি ও ভবন বিশ্ববিদ্যালয়কে ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কিছুটা থমকে যায়। এরপর ১৯১৭ সালে লর্ড চেমসফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসমূহ খতিয়ে দেখার জন্য মাইকেল স্যাডলারকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেন, যার নাম ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন। সেই কমিশনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।
সেই কমিশনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিবেদন দেয়। এই কমিশন মোট ১৩টি সুপারিশ করেছিল - যার মধ্যে ছিল, এটি হবে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিল হাউজের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করা। ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে শুরু থেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে বড় ধরণের ভূমিকা রাখেন আবুল কাশেম ফজলুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন পূর্ব বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার ছিলেন অন্যতম। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। শেষ পর্যন্ত ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় 'দ্যা ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯২০' অনুমোদিত হয়। গর্ভনর জেনারেল সেই আইনে স্বাক্ষর করেন ২৩শে মার্চ। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক রেজিস্ট্রার স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ ১৯২০ সালের পহেলা ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান। পরের বছর, ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। স্যার সলিমুল্লাহর দান করা ৬০০ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সেই সঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়া পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রাদেশিক সরকারের জন্য নির্মিত ভবনগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। (বিবিসি বাংলা)
সংক্ষেপে যদি বলি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক একটি শ্রেণির নানা ধরনের বাধার মুখে নানা প্রতিকূলতার বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা, উচ্চ শিক্ষার প্রথম কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বলা ভালো, বিশ্ববিদ্যালয় যাতে না হয়, ইংরেজ বড়লাট ও ভাইসরয়কে স্মারকলিপি প্রদান, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে সভা করেও দমিয়ে রাখা যায়নি নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সুদীর্ঘ ১০ বছরের সাধনা। প্রক্রিয়াগতভাবে ১৯১২ সালের নাথান কমিশন ও ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশনের প্রতিবেদনের পর ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আইনসভা ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পাস হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯২০’। পরে ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯২১ সালে মাত্র ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে শুরু হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। বর্তমানে ১৩টি ফ্যাকাল্টি, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট ও ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র, ২০টি হল ও তিনটি হোস্টেল রয়েছে। নিয়মিত মোট ৩৭ হাজার ১৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ১৯’শত ৯২ জন। এছাড়াও অধিভুক্ত ১০৫টি কলেজ ও ইনস্টিটিউটে ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন।
প্রাপ্তি : বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ এর ১১ দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এই ভুখণ্ডের মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক প্রায় সবাই ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর মূল্য দিতে হয়েছে চরমভাবে। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন দেশের তরে তাদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। এছাড়াও নব্বইয়ের স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ছিলেন স্যার পি জে হার্টস। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ এফ রাহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের মতো প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ প্রদান করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হয়। সম্প্রতি ইলিশ মাছের জিন রহস্য উদঘাটন, শ্যাওলা থেকে ন্যানোফিল্টার ও একটি নতুন এন্টিবায়োটিক ‘হোমিকরসিন’ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাত ধরেই আবিষ্কৃত হয়েছে।
অপ্রাপ্তি : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও এর উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসামান্য অবদান থাকলেও বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয় নানান নেতিবাচক বিষয়ের জন্য আলোচিত। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এক্ষেত্রে গবেষণাখাত বরাবরই অবহেলিত। ফলে এর প্রভাব পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকান্ডে। টাইমস হায়ার এডুকেশনের র্যাংকিং-এর ২০১৬ সালের সেরা বিশ্বের ৬০০-৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০২১ সালের র্যাংকিং-এ ১০০০ এর পরে তার অবস্থান নিয়েছে। অপ্রাপ্তির বেদনা হলো, শতবর্ষে এসেও কেনো আমরা পৃথিবীর সেরা দশে প্রবেশের মত একটি সুসংবাদ শুনতে পারলাম না? সেরা দশে আসা সম্ভব না হলেও এক শতাব্দীকালেও সেরা ১০০তে নয় কেনো? দুঃসংবাদ হলো, দলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি চলছে এখানে।
২৮ বছর পর ২০১৯ সালে এখানে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এখন আর ডাকসু নেই অনেকদিন হয়ে গেলো।ডাকসুর সাবেক সফল ভিপি ড. ফেরদৌস আহমদ কুরেশীর সাথে দৈনিক দেশবাংলায় কাজ করার সুবাদে ডাকসুর অপরিহার্যতা নিয়ে অনেকটা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেছিলাম। আর সেই প্রেক্ষিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে বর্তমান ভিসি ড. আখতারুজ্জামান স্যার থেকে সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে জাতীয় মানবাধিকার সোসাইটির এক অনুষ্ঠানে কৌশলে নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক কমিটমেন্ট আদায় করি। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে আমার কর্মস্থল নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত দৈনিক আমাদের নতুন সময়ে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান স্যারের সাক্ষাৎকার সম্বলিত আমার বাই নেমে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল, ‘ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ভিসি আখতারুজ্জামান : আদালতের বাধ্যবাধকতার কারণে বসেছি সঠিক নয়’। পুরো রিপোর্টটা পড়লে খুব মজা পাবেন প্রিয় পাঠক।’ ডাকসু নির্বাচন, আদালতের বাধ্যবাধকতায় কেন?’ শিরোনামে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে আমার আর একটি আলাদা আর্টিকেলও আমাদের সময় ডট কমে প্রকাশিত হয়। সেখানে আমি উল্লেখ করেছিলাম, ডাকসু থাকলে কোটা আন্দোলন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো আন্দোলনসহ এতকিছুর মুখোমুখি পড়তে হতো না সরকারকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার কিছুটা পরিবেশ তৈরি হতো। আজ নেই বলে তোফায়েল আহমদ, ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, আমীর হোসেন আমু, মতিয়া চৌধুরী, আসম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, ওবায়দুল কাদের, মাহমুদুর রহমান মান্না, আমান উল্লাহ আমানের মত নেতা তৈরি হচ্ছে কোথায়?
প্রশ্ন হলো : এখন কোথায় হারিয়ে গেলো ডাকসু? ডাকসু চলমান না থাকলে ‘গণতন্ত্র ও মুক্তবুদ্ধিচর্চা কতটা থাকে, এ এক বিরাট প্রশ্ন। মনে কষ্ট লাগে, আজকাল অনেক শিক্ষক গবেষণা বাদ দিয়ে রাজনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন প্রশাসনিক পদের লোভনীয় সুবিধার জন্য। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য ক্যাম্পাসে নষ্ট করছে রাজনৈতিক সহাবস্থান। আবাসিক হলে সিট পেতে নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের আনুগত্য করতে হয়। তারপরও ভিন্নমতালম্বী শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগতো প্রায়ই শোনা যায়। বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি নতুন বিভাগ খুলে অতিরিক্ত ছাত্রভর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতকে অসামঞ্জস্য করেছে বলেও অভিযোগ এসেছে। মোট শিক্ষার্থী সংখ্যার বিপরীতে নেই পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা। ফলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এছাড়াও হলগুলোতে অছাত্র ও বহিরাগতদের আসা ও থাকা বন্ধ করা এখনও হয়নি, যা দুঃখজনক।
এক শতাব্দী পেরিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করা হয়নি এখনও।অটোমেশনে পিছিয়ে পড়ে কিভাবে তাহলে বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে আমরা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাব? এই ব্যর্থতার দায় এড়াতেই কি ১০ টাকায় সমুচা-সিঙ্গারার গল্প? এর ফলে রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীসহ অন্যরা। তবে আশার খবর হলো, সম্প্রতি এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবশেষে বলব, আগামীকাল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন, তাই আজকেই করে ফেলতে হলো শতবর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠান। প্রশ্ন তো থেকেই যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতিরে কি কোনোভাবেই লকডাউন একদিন পেছানো যেতো না? সোমবারের লকডাউন যেখানে বৃহস্পতিবারে গেলো, সেখানে সগৌরবে শতবর্ষ পালনের মতো একটি বড় ইভেন্টের জন্য একটি দিন বিবেচনা করা যেতো না? নাকি অ্যালামনাইয়ের নেতৃত্বের যোগ্যতার প্রতি প্রশ্ন রেখেই শেষ করতে হবে?
লেখক : সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন