রাজধানীর চারপাশের চার নদী : বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগকে দূষণ ও দখলমুক্ত করার দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এ জন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্সের অধীনে ২১ সদস্যবিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করবেন নৌ-বাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মুহাম্মদ নিজামউদ্দিন আহমদ। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজধানীর চারপাশের এই চার নদী রাজধানীর প্রাণ। কয়েকশ’ বছর আগে ঢাকাকে যখন রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করা হয়, তখন এই চার নদীকে বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়েছিল। তখন চার নদীই ছিল পূর্ণ যৌবনা বিপুল স্রোতবাহী এবং স্বচ্ছ সলিলা। রাজধানী ছিল চার নদী দ্বারা সংরক্ষিত ও নিরাপদ। সময়ের বিবর্তনে চার নদী তার সকল বৈশিষ্ট্য, গৌরব ও কার্যকারিতা হারিয়েছে। প্রথমত, নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে; দ্বিতীয়ত, বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এবং তৃতীয়ত, এর দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা অবৈধ দখলে চলে গেছে। রাজধানীবাসীর স্বার্থে, তাদের কল্যাণ ও মঙ্গলার্থে এবং রাজধানীর সৌন্দর্যবর্ধনে নদীগুলো পুনরুজ্জীবিত করার, দূষণ ও দখলমুক্ত করার বিকল্প নেই। এই তাকিদ বহু দিন ধরে উচ্চারিত হলেও এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। এমতাবস্থায় চার নদী বাঁচাতে এবং দূষণ ও দখলের হাত থেকে মুক্ত করতে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা ইতিবাচক ও অভিনন্দনযোগ্য। সবচেয়ে বড় কথা, এ দায়িত্ব নৌবাহিনীকে দেয়ায় নিশ্চিত আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, উদ্যোগ সফল হবে, যথাসময়ে নদীগুলো নাব্যতা ফিরে পাবে, দূষণ ও দখল থেকে মুক্তিলাভ করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, নৌবাহিনীর তরফে ইতোমধ্যেই তিন স্তরের একটি কর্মপরিকল্পনা কিছু সুপারিশসহ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। এক, তিন ও পাঁচ বছরমেয়াদি কর্মপরিকল্পনায় যে রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে পর্যায়ক্রমে নদী থেকে ময়লা অপসারণ, নদীসীমানা নির্ধারণ করে দখলমুক্ত করা, দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং নদীপ্রবাহ ঠিক রাখতে খনন ও তীর সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে পৃথক একটি টাস্কফোর্স গঠন ও গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকিতে মনিটরিং কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এই সঙ্গে চার নদী ঘিরে একটি সার্কুলার ওয়াটার ওয়েজ চালুর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এ কথা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, বুড়িগঙ্গাসহ চার নদীর একটি বড় সমস্যা হলো : নির্বিচারে এসব নদীতে শিল্পবর্জ্য, কঠিন বর্জ্য, পয়োবর্জ্য, নৌযান বর্জ্য পতিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ শিল্পবর্জ্য, ১৫ শতাংশ, কঠিন বর্জ্য ১৫ শতাংশ পয়ঃসহ অন্যান্য বর্জ্য ও ১০ শতাংশ নৌযান বর্জ্য। অব্যাহত বর্জ্য পতনের ফলে নদীগুলোর তলদেশ যেমন ইতোমধ্যে ৮-১০ ফুট ভরাট হয়ে গেছে, তেমনি পানি ব্যবহারযোগ্যতা হারিয়েছে। অন্যদিকে চার নদীরই দুই পাড়ে বিপুল সংখ্যক অবৈধ স্থাপনা তুলে দখলদাররা দখল করে নিয়েছে। নদী সরু ও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এহেন বাস্তবতায় প্রথমত, সব ধরনের বর্জ্য পতন রহিত করার পাশাপাশি নদীর তলদেশ বর্জ্যমুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদীর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। তৃতীয়ত, নদী খনন করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে। নৌবাহিনীর দেয়া কর্মপরিকল্পনার রূপরেখার এসব কাজ সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করেছে সঙ্গত কারণেই। এ কথাও এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, প্রতিদিন রাজধানীতে যে হাজার হাজার টন বিভিন্ন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তার একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। রাজধানী থেকে শিল্প-কারখানা সরিয়ে নিতে হবে যাতে শিল্পবর্জ্যরে কারণে নদী দূষণের সুযোগ সৃষ্টি না হয়। নদী-দখলদারদের প্রতি জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করতে হবে।
আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, নৌবাহিনীর ওপর একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এই আস্থা ও বিশ্বাস থেকেই দায়িত্বটি অর্পণ করা হয়েছে যে, নৌবাহিনী আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, নৌবাহিনী কাজটি যথাযথভাবেই করতে পারবে। জাতিকে হতাশ করবে না। কাজটি বহুমুখী এবং খুব সহজ নয়। নদী দূষণের সঙ্গে, দখলের সঙ্গে অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালীরাও জড়িত। শিল্পকারখানা সরিয়ে দিয়ে কিংবা শিল্পকারখানার বর্জ্য-পতন রুখতে অনেক কিছু করতে হবে। অনেক বাধাও আসতে পারে। অন্যদিকে নদী দখলদাররা কম যায় না। দখল উচ্ছেদ যেমন বাধাগ্রস্ত হতে পারে তেমনি পুনর্দখল রোখাও কঠিন কাজ। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই কঠোর অবস্থান নিতে হবে। প্রয়োজন হলে নৌবাহিনী তার পরিকল্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সহযোগিতার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও নিতে পারে। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, কাজটি বিশাল এবং এ জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। এই অর্থের যোগান সরকারকে দিতে হবে। এখানে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না। সরকারকে মনে রাখতে হবে, অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে এটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। পুলিশ, প্রশাসন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সক্রিয় সহযোগিতা এ জন্য প্রয়োজন হবে। তারা সেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি। এ ব্যাপারে জনগণের সহযোগিতাও অপরিহার্য। জনগণকে তাদের স্বার্থেই সে সহযোগিতা দিতে হবে। রাজধানী, এখন ইট-কাঠ পাথর ও লোহার খাঁচায় পরিণত হয়েছে। এখানে মুক্তবায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া এবং উন্মুক্ত স্থানে দাঁড়িয়ে উদার আকাশ দেখার কোনো সুযোগ নেই। রাজধানীর চার নদী দূষণ-দখলমুক্ত হলে, নাব্য ও প্রবহমান হলে চার নদীর উভয় তীরে বৃক্ষায়ন, পার্ক, ওয়াকওয়ে ইত্যাদি হলে মানুষ শ্বাস নেয়ার, আকাশ দেখার এবং ভ্রমণ ও অবকাশ যাপনের সুযোগ পাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন